বর্ষণমুখর দিনের অভিজ্ঞতা
সোমা রানা (বি.এ বাংলা অনার্স), সুবর্ণরেখা মহাবিদ্যালয়
১. ভূমিকা :-
এই মায়াভরা পৃথিবীতে ষড়ঋতুর আনাগোনা লেগেই রয়েছে ৷ এর মধ্যে একটি ঋতু হচ্ছে বর্ষাকাল ৷গীষ্মের প্রচন্ড উত্তাপে চারিদিকের মাটি যখন ফেটে ফুটিফাটা হয়ে যায় ৷ ভ্যাপসা গরমে মানুষের জীবন যখন হাঁসফাঁস করতে থাকে ৷ ঠিক তখনই ছুটে আসে মৌসুমি বায়ু নিয়ে আসে পৃথিবীকে শান্ত সবুজ ও কোমল করবার জল৷ পৃথিবী সেজে ওঠে নতুন সাজে ৷
২. বর্ষাকাল ও বর্ষণমুখর দিন :-
আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল ৷ কিন্তু এই দুই মাসের মধ্যে বর্ষা সীমাবদ্ধ থাকে না ৷ তার খামখেয়ালি মেজাজ চলতে থাকে সারা বছর জুড়ে ৷ এই বর্ষাকালকে কেন্দ্র করে কৃষকের মন ময়ূরের মতো আনন্দে নেচে ওঠে ৷ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে তারা বুনে কত নতুন স্বপ্ন ৷ চারিদিক ভরে ওঠে শশ্যের সবুজ আভায় ৷
গ্রামের গৃহস্থ্য বাড়িব টিনের ছাদে বৃষ্টির ফোঁটা তাল বাজায় টাপুর টুপুর ছন্দ।
পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে প্রতিদিনের জীবনেও৷ চলমান জীবনে সময় থমকে দাঁডায় ৷ অলসতা এসে বাসা বাঁধে মানুষের মনে৷ কর্মজীবনের গতিশীল কাঁটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ সারাটা দিন মেঘের ঘনঘটা৷ সূর্য লুকিয়ে পড়ে মেঘের আড়ালে ৷
৩. প্রকৃতি ও বর্ষণমুখর দিন :-
বৃষ্টি মানুষের মনে ঝিমোনো ভাব ধরিয়ে দিলেও প্রকৃতিকে কিন্তু করে তুলে একেবারে সতেজ ও চাঙ্গা। গাছপালার গায়ের সমস্ত ধুলো ধুয়ে যায় | বৃষ্টিতে স্নান করে তারা নবযৌবনের মতো ঝলমলিয়ে ওঠে৷ চারিদিকে সবুজের রমরমা৷
ঝড়ো হাওয়া নাচিয়ে তোলে স্থির গাছপালাকে৷ নারকেল গাছ তালগাছ দুলতে থাকে ৷ বাঁশঝাড় মাটিতে ঝুঁকে পড়ে। বৃষ্টির ছোঁয়ায় এখানে সেখানে শোভা ছড়ায় কদম, জুঁই, কামিনি, গন্ধরাজ, স্পাইডার লিলির মতো সুগন্ধি ফুল ৷
বৈষ্ণব কবি থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ও তার পরবর্তী কবি লেখকেরা সবাই এই বর্ষারাণীর প্রেমে মুগ্ধ হয়েছিলেন ৷
‘গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি,গরজে গগনে গগনে ‘ |
বর্ষণ কখনও হয় ঝিরিঝিরি আবার কখনও হয় মুশলধারে৷ চারদিকের খাল-বিল পুকুর-নদীর জল কানায় কানায় ভরে যায় ৷ সবাই মিলে মিশে এক হয়ে যায় ৷ কুলুকুলু শব্দ করে প্রবল বেগে ছুটতে থাকে নদী-নালার লাল জল৷ রাস্তা ঘাটও জলে থৈ থৈ। বৃষ্টিতে ময়ূর পেখম তুলে নাচতে থাকে ৷
‘হৃদয় আমার আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে ৷”
চাতক পাখি অপেক্ষায় থাকে এই বর্ষার ছোঁয়া পাবার জন্য৷ গোরু – বাছুর সব গোয়ালে বন্দি হয় ৷ চড়াই ঘরের ফাঁক-ফকরে আশ্রয় নেয়৷ কাক ভিজে কাকভেজা হয়ে বসে থাকে ইলেকট্রিক তারে ৷ ছাগলগুলো সব দেওয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকে৷ হাস-মুরগিরা তাদের বাচ্চা – কাচ্চা নিয়ে কাঠগাদার তলায় চুপটি মেরে বসে থাকে৷
ডাহুক ডাকে ৷ ব্যাঙের গর্তে বৃষ্টিতে জল ঢুকে যায় | ফলে তারা চিৎকার চ্যেঁচামেচি শুরু করে দেয় ৷ এছাড়া বাবুই কতদিন আগে থেকেই এই বৃষ্টিতে যাতে ভিজতে না হয় তার জন্য বাসা বুনে রাখে৷ পিঁপড়ে খাবার সংগ্রহ করে রাখে।
৪. আমার অভিজ্ঞতা :-
“বৰ্ষণ মুখর দিনে-
কত স্মৃতি জাগে মনে
কত কথা গান হয় –
আনন্দ শিহরনে ৷ “
আমি গ্রামের মেয়ে ফলে বৃষ্টি ও বর্ষাকালের সাথে আমার নিবিড় সম্পর্ক | তবে সব বৃষ্টির দিন ধরা থাকে না মনে৷ একটা একটা বৃষ্টির দিন সত্যিই অপূর্ব যেগুলিকে মন থেকে কোনো দিন মুছে ফেলা যায় না ৷ তেমনি একটা বিশেষ দিনের কথা বলি –
দিনটি ছিল আমার দ্বিতীয় বর্ষের কলেজ পরীক্ষার দিন। সকাল থেকে ঘুম থেকে উঠেই দেখি চারিদিকে অন্ধকার তবে ঘড়ির কাঁটা বলছে বেশ অনেকক্ষন আগে থেকেই সকাল হয়েছে৷ রাত্রি থেকে অবিরাম মুশলধারায় বৃষ্টি পড়ছে৷ বৃষ্টি থামবার নামমাত্র চিহ্ন নেই। তবুও তো যেতে হবে কেননা পরীক্ষা বলে কথা৷ না গিয়ে উপায় নেই ৷ আমার অনেক দিনের পুরোনো রেইনকোটটা পরে বেরিয়ে পড়লাম৷ বৃষ্টির বেশির ভাগ দিন আমার কেটেছে ঘরের মধ্যে।
সেদিন নতুন চোখে দেখলাম বাংলার বর্ষণমুখর দিন৷ রাস্তায় লাল জলের ঢেউ, চারিদিকের খাল-বিলের পরিপূর্ণতা | কৃষকেরা মনের আনন্দে ধান গাছ লাগচ্ছে ৷ বাঁশের তৈরি বড় টুপি পরে হাল-লাঙল করছে৷ গ্রামের ছোটো ছোটো শিশুরা খালের জলে চুনো-পুঁটি ধরছে৷ আমি ঝাড়গ্রাম জঙ্গল-মহালের মানুষ ফলে গ্রামের যে দিকে গেলিই প্রথমে জঙ্গল পার হতে হয় ৷
সেদিন দেখলাম জঙ্গলের অপূর্ব অলেখ্য বর্ষার এক রূপ৷ চারিদিকে ঝমঝমিয়ে গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়ছে৷ জঙ্গল চিরে চলে গেছে লাল মোরামের রাস্তা। আর সেই রাস্তার উপর এসে পড়ছে জঙ্গলের ঢাল থেকে গড়িয়ে আসা বাড়তি জল৷
জঙ্গলের মধ্যে রাস্তার ধারে ধারে ফুটে রযেছে গ্লোব লিলি’ স্পাইডার লিলি, বনকুড়চি আরো কত নাম – না – জানা ফুল | এই বর্ষায় অরণ্যদেবী সেজে ওঠেন নববধূর সাজে ৷ সেই বর্ষাতে জঙ্গলের মধ্যে ভিজে ভিজে কত আদিবাসী মহিলা ছাতু কুড়াচ্ছে ৷ কুড়কুড়ে মাসরুম আঞ্চলিক ভাষায় একে বলে ‘রুটকা ছাতু‘ |
কেউ কেউ আবার শালপাতা তুলছে ৷
সুবর্ণরেখা নদীতে কত জেলে মাছ ধরছে, নদীর জল হু হু করে বেড়ে চলেছে ৷ যেন সে নব যৌবনে উন্মাদ হয়ে উঠেছে। ছোটো ছোটো শিশুরা ছাতা মাথায় স্কুলে চলেছে৷ চায়ের দোকানে ভিড় জমেছে৷ কত ভিক্ষেরি ঝুপড়িতে আশ্রয় নিয়েছে৷ সেদিনের সেই আলো-আঁধারী পরিবেশে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরলাম৷ কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম।
৫. দিনটি স্মরণীয় কেন :-
বাড়ি ফিরে দেখি নারকেল গাছটাতে বাজ পড়েছে ৷ আম গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে রান্না ঘরের চালে ৷ ভয়ংকর পরিবেশ৷ দুঃখ হল খুব | দেখি মা আমার জন্য খাবার নিয়ে বসে আছেন ৷ খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, পাঁপড় ভাজা, ইলিশ মাছের ভাজা, চাটনি ৷ আহা ! বড় তৃপ্তি ভরে খেলাম |
সকাল থেকে সন্ধ্যে হল তবুও বৃষ্টি থামলো না ৷ মনের মধ্যে কত কবি কবি ভাবনা এল ৷ মনে হল এই সেই কলিঙ্গ দেশের ঝড়বৃষ্টি | মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কবিতা –
‘ গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা /
কুলে একা বসে আছি নাহি ভরসা’ |
সারা রাত্রি ধরে ভাজা হল ঘুনিতে পড়া বিলের মাছ | রাত্রিতে শুয়ে শুয়ে শুনলাম ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝির কর্কশ শব্দ | মনের মধ্যে কত কথা এল পথের পাঁচালীর সেই অপু-দূর্গার কথা ৷ আমার শৈশবের ফেলে আসা সেই দিনগুলির কথা আমারা যখন রাস্তার জলে কাগজের নৌকা ভাসিয়ে কত খুশি হতাম | ভিজে ভিজে খালে ছুটে যেতাম মাছ ধরা আর বর্ষার থৈ থৈ রূপ দেখার জন্য ৷
সময়ের সাথে সাথে শৈশব হারিয়ে যায় ৷ যাগ গে, সব মিলে আজকের এই জঙ্গলের বৃষ্টি দেখার সুন্দর দৃশ্য সারা জীবন মনের ফ্রেমে বাঁধানো থাকাবে |
৬.বর্ষনমুখর দিনের নেতিবাচকতা :-
বর্ষা যেমন মানুষের মনে শান্তি নিয়ে আসে ঠিক তেমনি আবার ক্ষয়ক্ষতিও করে| প্রচুর বৃষ্টিপাতের জন্য অনেক জায়গায় বন্যা দেখা যায়৷ ঘর-বাড়ি ডুবে যায়৷ মানুষ ঘর ছাড়া হয়| পশু পাখিও আশ্রয় ছাড়া হয়।
এছাড়া গ্রামে-গঞ্জে কলেরা, আমশয়, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর মতো রোগের প্রকোপ দেখা যায়। এই সময় আবহাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে হওয়ায় অনেক বিষাক্ত পোকামাকড় ও সাপের উপদ্রব দেখা যায়| শহরাঞ্চলে পানীয় জলের সমস্যা দেখা দেয়৷
পর্যাপ্ত বৃষ্টি চাষের জন্য খুব জরুরী। কিন্তু বেশি বর্ষা হলে ফসলের অনেক ক্ষতি হয়| উচ্চবৃত্ত মানুষের কাছে বৃষ্টির দিন মানে অবসরের দিন৷ কিন্তু সাধারন খেটে খাওয়া,দিনআনা- দিনখাওয়া মানুষেরা কর্মহীন হয়ে পড়ে এই বর্ষাকালে৷ না খেয়ে অনাহারে থাকতে হয় তাদের৷
এছাড়া স্কুল পড়ুয়াদেরও স্কুলে যাওয়া আসার জন্য অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় | যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়| এমনকি গাছপালা পড়ে ইলেকট্রিক সরবরাহও বন্ধ হয়|
৭. উপসংহার :-
বর্ষাকাল ঘুরে ফিরে আসে এই পৃথিবীতে ৷ সে কখনো নিয়ে আসে সুখ-শান্তি- কোমলতা – সবুজতা | কিন্তু তার আধিক্য নিয়ে আসে অনেক দুঃখ-কষ্ট কর্মহীনতা, আশ্রয়হীনতা৷ তাই বর্ষাকালের যেমন ইতিবাচকতা আছে ঠিক তেমনি আছে নেতিবাচকতা | তবুও মানুষ অধীর আগ্রহী হয়ে থাকে বর্ষাকে আহ্বান করার জন্য। কারন বর্ষা এলে পৃথিবী সাজবে নববধূর সাজে৷ মানুষ চায় জল চায় সতেজতা | এইভাবেই ঘুরে ফিরে আসুক বর্ষাকাল সে নিয়ে আসুক সুখ-সমৃদ্ধি সবুজতা, সতেজতা , চঞ্চলতা , কোমলতা | এটাই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি ৷