“জাগরী” উপন‍্যাসের মূল‍্যায়ণ

অদিতি সিংহ, স্নাতকোত্তর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়


ভূমিকা:
সতীনাথ ভাদুড়ীর জাগরী উপন্যাসটা রাজনীতির সময়ে অবস্থিত হয়েও সঠিক হারে রাজনৈতিক নয়। “জাগরণ” বা “জেগে ওঠা” থেকে জাগরী শব্দটার উৎপত্তি হয়েছে। এই উপন্যাস প্রকাশের মধ্যে রয়েছে এক আস্ত একটি গল্প।
       জাগরী সতীনাথ ভাদুড়ী কর্তৃক লিখিত একটি বাংলা উপন্যাস। উপন্যাসটি ভারতীয় সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্ম হিসেবে বিবেচিত হয় ১৯৪৫ সালে উপন্যাসটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। এটি অর্ধ-আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। এর কাহিনি পটভূমি ১৯৪০ এর দশকের ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ কে কেন্দ্র করে নির্মীত।
       মানুষের মনে চলতে থাকে নানা কথা, তা কোন সময় প্রকাশ পায়, আবার কক্ষনো প্রকাশ পায় না। সেই সমস্ত অপ্রকাশীয় কথা যা মনের মধ্যে দিনরাত দন্ধ বাঁধে তা ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসের মাধ্যমে।

প্রিয় উপন‍্যাসের পরিচয়:
উপন্যাসের নাম: “জাগরী”
লেখক: সতীনাথ ভাদুড়ী
প্রকাশকাল: ১৯৪৫ সালে
উৎসর্গ: যে সকল অখ্যাতনামা রাজনৈতিক কর্মীর কর্মনিষ্ঠ ও স্বার্থ ত্যাগের বিবরণ, জাতীয় ইতিহাসে কোনদিনই লিখিত হইবে না, তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে_

লেখক পরিচিতি:
সতীনাথ ভাদুড়ী ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯০৬ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় সমকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত “জাগরী ” উপন্যাস তাঁকে খ্যাতি এনে দেয়। এই গ্রন্থটির জন্য ১৯৫০ সালে তিনি “রবীন্দ্র পুরস্কার” লাভ করেন। বইটি ১৯৬৫ সালে ইউনেস্কো প্রতিনিধিত্বমূলক সাহিত্যকর্মের সংকলনের অংশ হিসেবে ইংরেজিতে অনূদিতও হয়। তাঁর লেখা অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল উপন্যাস “ঢোঁড়াই চরিত মানস” (দুই খণ্ডে), “অচিন রাগিণী “এবং “জার্নাল সত্যি ভ্রমণকাহিনী”। সতীনাথ ভাদুড়ী বহু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এবং “চিত্রগুপ্ত” ছদ্মনামেও সাহিত্য রচনা করেন।

‘জাগরী’ উপন‍্যাসের বিষয়বস্তু :
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম সাড়া জাগানো উপন্যাস। প্রকাশকাল ১৯৪৫ সালে গ্রন্থটি সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রথম প্রকাশিত হলেও কোথাও প্রথম প্রচেষ্টার সামান্যতম জড়তার চিহ্নমাত্র নেই। একেবারে ওস্তাদ লিখিয়ের মত সর্বত্র পরিণতির ছাপ। উপন্যাসের বিষয়বস্তু পূর্ণিয়া প্রবাসী একটি বাঙালি পরিবার কেন্দ্রিক; বাবা,মা, দুই ছেলে-ডাকনাম বিলু ও নীলু। বাবা ছিলেন ওখানকারই একটি স্কুলের হেডমাস্টার,বিদ্যা ও ব্যক্তিত্বের জোরে সকলের কাছেই সম্মানিত – সকলের মাস্টারসাহেব। গান্ধিবাদী আন্দোলনের প্রতি প্রবল আস্থাতে চাকুরি ছেড়ে সেখানেই আশ্রম খুললেন। আশ্রমই হলো কংগ্রেসের অফিস। খাওয়া-দাওয়া, কাজ-কর্ম,সবই চলতে থাকলো মহাত্মার আশ্রমের অনুকরণে। মা আশ্রমের গৃহস্থালীর দায়িত্ব সামলাতে থাকলেন। বিলু, নীলু আশ্রমেই বড়ো হলো। বড়ো ছেলে বিলু ম্যাট্রিক পাশ করলো কিন্তু আশ্রমের আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তাকে আর কলেজে পড়ানো চলল না। কাশী বিদ্যাপীঠে পড়ে সে শাস্ত্রী উপাধি পেল। ছোটো ছেলে নীলু কলেজে পড়েই পাশ করলো।
        দুইভাই গান্ধিবাদের পথে আশ্রম থেকে কংগ্রেসের স্বার্থে কাজ করতে থাকে; মাঝে মাঝে জেলও খাটতে থাকে। যেমন তাদের বাবা খাটেন। ক্রমে এ কাজ ও পথের উপর দু’ভাইয়ের সংশয় ও বিরাগ তৈরি হল-যোগ দিল কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টিতে। নতুন উদ্যমে এ পার্টিতে দু’ভাই কাজ করতে লাগলো। তারপর যথা নিয়মে আবারও জেল। এই জেলের মধ্যে ‘চন্দ্রদেও’-এর সাথে পরিচয়; তার লেকচার ও অকাট্য যুক্তিতে উদ্বুদ্ধ হ’য়ে ছোটভাই নীলু কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টি ছেড়ে যোগ দিল কম্যুনিস্ট দলে। তখন ১৯৪২ এর আগস্ট আন্দোলন। সরকারি হুকুমে আশ্রম ও কংগ্রেস অফিস ‘জপতো’ হলো। বাবা-মা দুজনেই জেলে সিকিউরিটি বন্দী। আগস্ট আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে বিচারে বড়ো ভাই বিলুর ফাঁসির হুকুম হলো। রাত পোহালেই বিলুর ফাঁসি, তাই তাকে কঠোর নিরাপত্তায় রাখা হয়ে ফাঁসি সেলে। ঐ একই জেলের আপার ডিভিশন সেলে বন্দী পিতা মাস্টারসাহেব আর মহিলা সেলে তীব্র উৎকণ্ঠায় মা বন্দী জীবন অতিবাহিত ক’রে চলেছেন। কী অভূতপূর্ব মানসিক দ্বন্দ্বের রুদ্ধশ্বাস আবহ পাঠককে রোমাঞ্চিত করে। এদিকে ছোটোভাই কম্যুনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে দাদার বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। আর সৎকারের জন্য ছোটোভাই নীলু দাদার দেহ নিতে অপেক্ষা করতে থাকে জেলগেটে।

         কোনো বইকে জানতে হলে আগে সেই লেখক কে জানতে হবে। লেখককে সম্পূর্ণ জানা যায় তার লেখার মাধ্যমে। সতীনাথ ভাদুড়ী পরিবেশ সচেতন মূলক, ও পরিবেশের প্রতি সজাগ একজন ব্যক্তি। তিনি পাতাদের কথা বলা, ফুল ফোঁটার শব্দও শুনতে পেতেন। চলে যাওয়ার ৫০ বছরে তিনি বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে বিনোদ ঘোষালভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলের ঠান্ডা মেঝেতে বসে ঘাড় গুঁজে একমনে কী যেন লিখে চলেছেন এক বন্দি হয়ে। সকলের যেখানে ছাড়া পাওয়ার দিন গুনছে আর তিনি সাহিত্য রচনা করছেন।
অতীতের ইতিহাস ঘেরা বর্ণিত কাহিনী হচ্ছে সাহিত্য। যা প্রতি মুহূর্তে মানুষের মন ও চেতন কে জাগ্রত করে। যে সে বন্দি নন তিনি ছিলেন একেবারে রাজবন্দী।

জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে আর্জি জানিয়েছেন তাঁকে যেন কোনও একটি ‘টি সেলে’ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাহলে তিনি শান্ত ভাবে বসে পড়াশোনা করতে পারবেন।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন,
‘‘বলেন কী মশাই! ওখানে কেন?’’
বন্দির উত্তর,  “একা থাকলে লেখাপড়ার কাজটা ভাল হয়।”
সুপারিন্টেন্ডেন্ট: “বেশ, ব্যবস্থা করছি তাহলে।”
ব্যবস্থা হলেন। আর ওই টি-সেলে বসেই রুল টানা খাতায় ও পেন্সিলে লেখা হল এক উপন্যাস, যার নাম দিলেন “জাগরী”। লেখক ‘ভাদুড়ীজি’। সতীনাথ ভাদুড়ী। সময়টা ১৯৪২। গোটা ভারতবর্ষ তখন গাঁধীজির ভারত ছাড় আন্দোলনের জ্বরে কাঁপছে। লেখক হিসেবে একেবারেই নতুন, কে পড়বে তার ওই লেখা?

         উপন্যাসে রয়েছে একটি পরিবারের চারজন সদস্য। মা বাবা বিলু আর নীলু। এক রাতের কথা বর্ণনা হয়েছে গোটা উপন্যাস ঘিরে। তাদের মনের মধ্যে চলতে থাকা নানা কথোপকথন যা কেবল আত্মকেন্দ্রিক, তাই প্রকাশ পেয়েছে এই উপন্যাসে। লেখক নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। শুধুমাত্র উপন্যাস বললে ভুল হবে, এটি লেখকের নিজস্ব পরিচয় স্থাপন সূত্রপাতের ইতিহাস বর্ণিত।

লেখকের বক্তব‍্য:
          আইনজীবী পরিবারের সন্তান হয়েও, নিজের জেদ ও নিজস্ব স্বাধীনতা নিয়ে লেখকের মনে এক উদ্বিগ্ন ভাবনা জাগ্রত হয়। যা লেখককে সকলের কথা ভাবতে বাধ্য করে। তিনি অনায়াসে পরিবেশকে কাছে টেনেছিলেন, ফুল ফোটা ও পাতার শব্দ শুনতে পারতেন।
        উপন্যাসটি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের (১৯৪২) পটভূমিতে রচিত। এটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সাধারণ বাঙালি জনগণের সম্পৃক্ততার কথা তুলে ধরে। সতীনাথ ভাদুড়ী নিজে ১৯৪২-৪৪ সালে রাজনৈতিক বন্দি হিসাবে ভাগলপুর জেলে আটক ছিলেন। সমসাময়িক ভারতীয় রাজনীতি এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তিনি এই উপন্যাসের কাহিনিতে বহু আত্মজৈবনিক উপাদান যোগ করেছেন।

ভালো লাগার কারণ:
       একটি পরিবারের চারজন সদস্য। ছেলের ফাঁসি হবে শুনে, পরিবারের সকল শেষ মুহূর্তে একে অপরকে ছাড়া আত্মহারা। মনের মত চলতে থাকা নানা দ্বন্ধ, সেই সমস্ত দ্বন্দ্ব ও মোর ঘরানো ট্রাজেডি নিয়েই এই উপন্যাস গঠিত হয়েছে।
      উপন্যাসটি চারজন ভিন্ন ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে গৃহীত, উত্তমপুরুষে লিখিত। রাজনীতির আবর্তে চক্রায়িত এক পরিবার- মাতা, পিতা এবং দুই পুত্র। এক পুত্রের সাক্ষ্যের পরিপেক্ষিতে আর এক পুত্র বিপ্লবী বিলুর মৃত্যুদন্ড হয় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়। উপন্যাসটি শুরু হয়, বিলুর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগে জেল হেফাজতে তার শেষ রাত থেকে।
       প্রথম অধ্যায়টি বিলুর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়েছে, যেখানে সে নিজের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে। তার সঙ্গে সংঘটিত অমানবিক নির্যাতনের কথাও এখানে বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ অধ্যায়ে তার বাবা, মা এবং ভাইয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে একই গল্প বর্ণনা করা হয়েছে। তারা সকলেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় তাদের নিজস্ব চিন্তা, উদ্বেগ এবং অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করে।

● উপসংহার:
একটা উপন্যাস বা সাহিত্য রচনা করা হয় সময়ের উপর নির্ভর করে, মানুষ যে সময় অবস্থান করে সেই সময়ের ইতিহাস ফুটে ওঠে লেখায়। একটি পরিবারের চার সদস্য, তাদের একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী মতবাদ। সেই সমস্ত মনস্তাত্ত্বিক রূপ ও আত্ম চেতনামূলক বক্তব্য ফুটে উঠেছে জাগরী উপন্যাসের মাধ্যমে।