পথের পাঁচালী উপন্যাস মূল্যায়ন
পূজা দাস এম.এ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)
● ভূমিকা:
ত্রিশের কালে প্রকৃতি চেতনার জন্য দুজন শিল্পীর খ্যাতি এখনো প্রায় সর্বজন স্বীকৃত। এদের একজন হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অপরজন হলেন জীবনানন্দ দাশ। রবীন্দ্র সমসাময়িক কালে যে ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাব বাংলা কথা সাহিত্যে জগতে নূতন যুগের সূচনা করেছিলেন তাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা কথা সাহিত্য উপন্যাসের ধারায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাব যেমনি আকস্মিক তেমনি বিস্ময়কর। সাধারণ ঘরে জন্মগ্রহণ করে সারা জীবন স্কুল মাস্টারি করে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসে যে অদ্ভুত সিদ্ধি লাভ করেছেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। উপন্যাস ও ছোটগল্প রচনাকে স্ব ক্ষেত্র রূপে নির্বাচন করলেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বতন্ত্র এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন স্বাধীন। যে তিনটি প্রধান উপাদানকে অবলম্বন করে তার সাহিত্য জগৎ সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে অন্তর্গত আছে প্রকৃতি চেতনা, আধ্যাত্ম চেতনা এবং বিশ্ব চেতনা স্বরূপ উপলব্ধি। এই তিনটি সংযোগে সৃষ্ট জীবনাদর্শনকে তিনি তাঁর সাহিত্যক্ষেত্রের রূপায়িত বা প্রতিষ্ঠা প্রদান করার চেষ্টা করেছেন। মূলত পথের পাঁচালী উপন্যাস রচনা মধ্য দিয়েই তাঁর সাহিত্য সাধনার ক্ষেত্রে যাত্রা শুরু।
● উপন্যাসের পরিচয়:
“পাঁচালী” শব্দের অর্থ হলো “গীতিকাব্য”।অপুর জীবনের পথ যার সাথে জড়িয়ে আছে সেই সংসার জীবন ও প্রকৃতি তার পাঁচালী রচনা করেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।এই উপন্যাসে বিভূতিভূষণ প্রকৃতির যে সৌন্দর্য রূপ, তার বিস্তর বর্ননা করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। বিভূতিভূষণ পথের পাঁচালী উপন্যাসটি রচনা করেছেন কার্যোপলক্ষে অধুনা বিহারের ভাগলপুরে থাকাকালীন সময়ে। ভাগলপুরের “বড়বাসাতে” থাকাকালীন ১৯২৮ সালের ২৬ শে এপ্রিল তিনি উপন্যাসের পান্ডুলিপি পুরোটা নির্মাণ করেন এবং তা প্রেরণ করেন ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে, যাতে সেটি ‘বিচিত্রা’ মাসিক পত্রিকায় প্রকাশ পায়। উল্লেখযোগ্য বিষয় এই সময়ই ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি। ১৯২৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে সজনীকান্ত দাসের প্রচেষ্টায় ‘রঞ্জন’ প্রকাশনায় থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ‘পথের পাঁচালী’ সমগ্র উপন্যাস।
সমগ্র উপন্যাসে তিনটি খন্ডে ও মোট ৩৫টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। খন্ড তিনটি হল – ক)বল্লালীবলাই (পরিচ্ছেদ ১নং থেকে ৬নং পর্যন্ত) এখানে ইন্দির ঠাকুরনের বর্ণনা, হরিহরের বংশ পরিচয় এবং ঠাকুরের মৃত্যুর বর্ণনার পরিচয় পাওয়া যায়।
খ) আম আঁটির ভেঁপু (৭নং থেকে ২৯ নং পর্যন্ত) এখানে অপুর দুর্গার এক সাথে বেড়ে ওঠা,দূর্গার মৃত্যু, সপরিবারে হরিহরের নিশ্চিন্তপুর ত্যাগ ও কাশী যাত্রা। গ)অক্ররসংবাদ (৩০নং থেকে ৩৫নং) অপুদের কাশীজীবন, হরিহরের মৃত্যু, সর্বজয়ার কাজের জন্য কাশী ত্যাগ ও অবশেষে নিশ্চিন্দিপুর ফিরে আসার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
● লেখক পরিচিতি :
ভারতীয় কথাসাহিত্যের আকাশে বিভূতিভূষণ নামক নক্ষত্র ১২ই সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে(বাংলায় ২৮শে ভাদ্র ১৩০১ সালে)বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার কাঁচরাপাড়ার নিকটবর্তী ঘোষপাড়া মোড়াতিপুর গ্রামে নিজের মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তবেতবে তবেতবে তারতার পৈতৃক আদি নিবাস ছিল উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ নিকট ব্যারাকপুর গ্রামে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতাপিতা ছিলেন মহানন্দ বন্দোপাধ্যায় এবং মাতা ছিলেন মৃণালিনী দেবী। পাণ্ডিত্য ও কথাকতার জন্য মহানন্দ বন্দোপাধ্যায় শাস্ত্রী উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। বিভূতিভূষণ ছিলেন মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মৃণালিনী দেবীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ। বিভূতিভূষণ সবার অমতে ২৩ বছর বয়সে গৌরীদেবীকে বিবাহ করেন। বিয়ের এক বছর পরই গৌরীদেবী নিউমোনিয়ায় মারা যান এবং প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর বাইশ বছর পর রমা চট্টোপাধ্যায়কে বিবাহ করেন। তাদের একমাত্র সন্তান তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। এই মহান ব্যক্তির প্রথম শিক্ষার পাঠ শুরু হয় পিতা মহানন্দের হাত ধরে। বাল্যকাল থেকেই তিনি মেধাবী ছিলেন। অত্যন্ত দারিদ্র্য জীবন কাটাতে হয়েছে তাই কিছুদিন তিনি নিজের গ্রামের পাঠশালায় পড়াশোনা করার পর বনগাঁ ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণীতে পাঠরত অবস্থায় তিনি পিতৃবিয়োগ হন। পিতৃশোক কাটিয়ে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষার প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয় এবং তার ঠিক ২ বছর পর কলকাতায় রিপন কলেজে (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) আই.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগ ও আইন বিভাগ দুটি বিষয় ভর্তি হন। ১৯১৯ সালে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কর্ম জীবনে প্রবেশ করেন। প্রথম জীবনে তিনি হুগলি জেলা অন্তর্গত জাঙ্গিপাড়া মাইনর স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি সোনারপুর হরিনাভি স্কুলেও কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। তারপর ‘গো-রক্ষিনী সভার’ ভ্রাম্যমান প্রচারক হিসেবেও কিছুদিন চাকরি করেন। এরপরে তিনি জমিদার অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি, গৃহশিক্ষক ও ভাগলপুরের সার্কেলের সহকারী ম্যানেজার নিযুক্ত হন।পরে কলকাতা ধর্মতলায় খেলাতচন্দ্র ক্যালকাটা ইনস্টিটিউশন মেমোরিয়াল বিদ্যায়তনে আবার শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। তিনি কল্লোলের যৌবনদীপ্ত উত্তরনের মধ্য দিয়ে পদচালনা করেছেন সাহিত্যে। ১৩২৮ বঙ্গাব্দে ‘প্রবাসীর’ মাঘ সংখ্যার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘মেঘমল্লারে’ প্রকাশিত ‘উপেক্ষিতা’ নামক গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্য জীবনে প্রবেশ করেন। ভাগলপুরে চাকরিরত অবস্থায় তিনি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস রচনার শুরু এবং তা সমাপ্ত করেন ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে।
◆ তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস গুলি হল –
‘অপরাজিত’ (১৯৩২) ‘দৃষ্টি প্রদীপ'(১৯৩৫) ‘আরণ্যক (১৯৩৯), ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল'(১৯৪০)’বিপিনের সংসার'(১৯৪১) ‘দেবযান'(১৯৪৪) ইত্যাদি।
◆ এছাড়া তাঁর রচিত সরস মধুর গল্প গ্রন্থ গুলি হল- ‘মেঘমল্লার'(১৯৩১)’মৌরীফুল’ (১৯৩২) ‘যাত্রাবদল'( ১৯৩৪) ‘জন্ম ও মৃত্যু'(১৯৩৭) ‘কিন্নরদল'(১৯৩৮) ‘তালনবমী’ (১৯৪৪) ইত্যাদি।
◆ ভ্রমণ কাহিনী ও দিনলিপি গুলি হল – ‘অভিযাত্রিক’,’স্মৃতির রেখা’,’তৃণাঙ্কুর’ প্রভৃতি। অনুবাদ উপন্যাস হলো আইভ্যান হো।
তাছাড়াও অধুনা অন্যান্য গুলি হল- ‘বিচিত্র জগত’ (১৯৩৭)’টমাস বাটার আত্মজীবনী’, ‘আমার লেখা’ (১৯৬৮)
ঝাড়খন্ডের ঘাটশিলাতে, ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর (১৭ই কার্তিক ১৩৫৭ বঙ্গাব্দ,বুধবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। পরদিন দুপুরে সুবর্ণরেখা নদীর ওপরে ‘পঞ্চপাণ্ডব ঘাট’-এ তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।
● ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত বিষয়বস্তু:
কাহিনী উপন্যাসের মূল উপাদান পথ। উপন্যাসের কাহিনী তিনটি পর্বে অঙ্কিত। এই উপন্যাসে কাহিনী শুরু হয়েছে বল্লালী বলাই পর্বে নিশ্চিন্তপুর গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ হরিহর ও তার স্ত্রী সর্বজয়ার পরিবারকে কেন্দ্র করে। গ্রামের অসহায় দরিদ্র পরিবারের দুটি সন্তান আছে একটি কন্যা সন্তান নাম দুর্গা এবং অপরজন পুত্র সন্তান নাম অপু। এছাড়াও আরো একজন বৃদ্ধা সদস্য আছে পরিহারে। তার পরিচয় পাওয়া যায়, তিনি হলেন হরিহরের দূর সম্পর্কে সম্পর্কের দিদি, ইন্দির ঠাকুরন এই ইন্দির ঠাকুরনের কোন সন্তান ছিল না বা তাকে দেখাশোনার মতো তার আপন কেউ ছিলনা। কারণ সে তার সন্তানকে খুব অল্প বয়সেই হারিয়েছে। তাই ইন্দির ঠাকুরনের কাছেতার মৃত মেয়ে বিশ্বেশ্বরীর প্রতীতী হয়ে ওঠে দুর্গা, প্রতি সন্ধ্যাই দুর্গা ইন্দির ঠাকুরনের কাছ থেকে নানা রূপকথার গল্প শোনে। এই নিয়ে বেশ ভালোই চলছিল কিন্তু বাধসাধে সর্বজয়া,ঝগড়া করে ইন্দির ঠাকুরনকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং অবশেষে শেষ বয়সে ইন্দির ঠাকুরন বাধ্য হন গ্রামের প্রান্তে কুঁড়েঘরে বাস করতে। তারপরে ইন্দির ঠাকুরনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন চরম কষ্ট ও অবহেলার মধ্যে, যেখানে সে নিজের মৃত্যু যাত্রা পথে বংশের কারো হাতে জল পায় না। দুর্গা যখন নিঃসঙ্গ ও একা হয়ে পড়েছে ইন্দির ঠাকুরনকে হারিয়ে তখন যেন তার একাকীত্ব কাটাতে অপু তাকে সঙ্গ দেয়। এর পরে ‘আম আঁটির ভেঁপু’ অংশে দুর্গা ও অপুর চোখে প্রকৃতির বিস্ময় ভরা সৌন্দর্য লেখকের উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। অপু ও দুর্গা কিশোর চোখে যা চেয়ে দেখে তাতেই মুগ্ধ হয়। অপু ৬ বছর বয়সে বাড়ির বাইরে আসে, প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ সে প্রাণ ভরে অনুভব করে। দুর্গা ও তার ভাই অপু সর্বদা দুঃসাহসিক কাজ করে বেড়াই যেমন – বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো, আদিবাসী খেলায় অংশগ্রহণ করা, গোপনে ফুল ফল পাড়া, রেললাইন দেখতে যাওয়া,মাকে না জানিয়ে বনভোজন ইত্যাদ। এইসব কাজের জন্য তাদের কম অপদস্ত হতে হয়নি তাদের মায়ের হাতে। বিশেষ করে দুর্গাকে প্রচন্ড মারধর সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু তাতে তাদের কল্পনা প্রবণ মন থেমে থাকেনি। এরপরে পাওয়া যায় অপুর প্রসন্ন গুরু মহাশয়ের পাঠশালায় ভর্তি হবার কাহিনী। গ্রামের কিছু প্রবীণ ভদ্রলোক জড়ো হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে সময় কাটাত, যা শুনতে অপুর খুব ভালো লাগতো। এই প্রথম অপু বাইরের জগৎ পদার্পণ করে যা তোর মনকে উত্তেজনা ও আনন্দে ভরিয়ে তোলে। গ্রাম্য উৎসব, যাত্রা, মেলায় ইত্যাদি গ্রামীণ জীবন প্রভাবে বৈচিত্র ও রোমাঞ্চ নিয়ে আসে। কিন্তু হঠাৎ করে ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয় দুর্গার ম্যালেরিয়া জ্বরে মৃত্যুর ঘটনা এবং তার ছোট ভাই অপুর একা হয়ে যাওয়া। মৃত মেয়ে দুর্গার স্মৃতি কাটাতে ও জীবিকা নির্বাহের তাগিদে হরিহর সিদ্ধান্ত নেয় তারা কাশি যাত্রা করবে। পরে তারা সমস্ত কিছু গোছগাছ করে স্টেশনে যায়। ট্রেন ছেড়ে দিলে ট্রেনের সাথে সাথে তাদের সুখ-দুঃখের সকল স্মৃতি চিরকালের মত পিছনে রেখে চলে যায় কাশীতে। এর পরের পর্ব ‘অক্রুর সংবাদ’ অংশে কাশিতে হরিহরের জীবিকা নির্বাহ, অপুর পড়াশোনা বর্ননা, অপুর লেখার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়, হরিহরের মৃত্যু হয় কাশিতে থাকাকালীন, হরিবারের মৃত্যুর পর সর্বজয়া সংসার চালানোর তাগিদে কাশীতে কোন এক ভদ্র বড় লোকের বাড়িতে রাধুনীর কাজ নেয়। এখানে সর্বজয়া যেন পরাধীন খাঁচার মধ্যে বন্দী হয়ে যায়, অবশেষে নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে সর্বজয়া ও অপু আবার নিশ্চিন্দিপুরে তাদের পুরনো ভিটেই আবার ফিরে যায়।
● ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের চরিত্র পরিচয় :
কোন উপন্যাস বা ছোটগল্প রচনার প্রধান উপাদান চরিত্র। চরিত্র ছাড়া উপন্যাস বা ছোটগল্প রচনা অসম্ভব। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসেও আমরা নানা চরিত্রের পরিচয় পায়। দুর্গা ও অপুর কিশোর হলেও এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। পথের পাঁচালী উপন্যাসের সর্ব প্রধান চরিত্র অপু। হরিহর রায় নামক এক দরিদ্র ব্রাহ্মনের সন্তান হলেও তার প্রকৃত পরিচয় ও ঠিকানা নিশ্চিন্দিপুরের নিসর্গ প্রকৃতি। গাছগাছালি নিশ্চিন্দিপুরের ধুলোমাটি ভূমিষ্ঠ শিশু প্রথম চোখ মেলে দেখেছে এই উদার প্রকৃতিকে, প্রকৃতিও তাকে নিজের করে নিয়েছে। অপু চরিত্রগত দিক থেকে শান্ত ধীর, স্থির ও স্বপ্নালু। তার যেটুকু বাউন্ডুলে স্বভাব তা তার দিদির সংস্পর্শে। দিদি দুর্গার হাত ধরেই তার প্রথম প্রকৃতির রাজ্যে প্রবেশ। ছোটবেলা থেকে পুরান, মহাভারত, রূপকথারগল্প,ছড়া শুনে তার মন কল্পনা প্রবণ হয়ে উঠেছে, সে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। তার সেই কল্পনা প্রবণতা হলো – ‘ছায়া ভরা বৈকালটিতে নির্জন বনের দিকে চাহিয়া তাহার অতি অদ্ভুত কথা সব মনে হয়’ তার মনে হয় ‘আজন্ম সাথী সুপরিচিত এই আনন্দ ভরা বহুরূপী বনটার সঙ্গে কত রহস্যময়, স্বপ্ন দেশের বার্তা যে জড়ানো আছে’। শিশু মন এমনিতেই অজানা রহস্যের প্রতি একটু বেশি আকর্ষন বোধ করে। অপুর অনুসন্ধিতৎসার সঙ্গে তার ইচ্ছা পূরণের যে চেষ্টা সেটাও চলতো। তার বড় দৃষ্টান্ত তার বাবার ‘সর্ব দর্শন সংগ্রহ’ পড়ে সেই শকুনের ডিম মুখে পুরে আকাশে উড়ে বেড়ানোর প্রচেষ্টা করে। একদিকে অজানা ও দূরের প্রতি আকর্ষণ অন্যদিকে চির পরিচিতের প্রতি আশক্তি ছোটবেলা থেকেই অপুর মনে এক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে। কল্পনায় দূরে ভেসে যাওয়া, আবার ছুটে মায়ের কাছে আসা একদিকে নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম ছাড়ার বেদনা অন্যদিকে গ্রাম থেকে বেরিয়ে মুক্তির আবেশ এই দুই বিপরীত মুখি আবেগে বারবার দোলায়িত হয় তার শিশুমন। অপুর বয়সী ছেলেদের মধ্যে আত্মমর্যাদা ও আত্মপ্রতিষ্ঠা প্রবল। তাই সে তার কাশির বন্ধুদের কাছে তার বাবার পরিচয় লুকায়, এমনকি ঘাটের কথক ঠাকুরের কাছেও তার বাবার পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করে। সে জানায় যে তার বাবা একজন কন্ডাক্টর। লুকিয়ে নিষিদ্ধ চুরুট খাওয়ার উত্তেজনা এবং লীলার প্রতি মুগ্ধতার ভালোবাসার রোমান্টিক অনুভূতিতে অপুর কিশোর মন অপরূপ শিল্প স্বার্থকতা লাভ করে। এককথায় বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী উপন্যাসে অপুর পরিণত জীবনের কোন বর্ণনা নেই আছে কৈশোরের যা তিনি অপরূপভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
এরপরে আসা যাক, দুর্গার চরিত্রে। উপন্যাসে হরিহর ও সর্বজয়ার কন্যা রূপে আবির্ভূত হলেও তার প্রকৃত পরিচয় সে অপুর দিদি। উপন্যাসের দুটি পর্বে সে বর্তমান। ‘অক্রুর সংবাদ’ অংশে তার দৈহিকভাবে উপস্থিতি না থাকলেও অপুর স্মৃতিচারণায় বারবার উঠে এসেছে সে। উপন্যাসের পাঠকের সাথে যখন তার প্রথম পরিচয় তখন তার বয়স সাত বছর। দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও দারিদ্রতার দুঃখ যেন তাকে স্পর্শ করে না। সে বড় দুরন্ত, বনে জঙ্গলে সে একাকী ঘুরে বেড়াই, বনে জঙ্গলে আড়ালে আবডালে কোথায় কি পাওয়া যায় সবই তার নখ দর্পণে। প্রকৃতি যেন তার ক্ষুধার যোগান দেয়, এমন কি প্রসাধনেরও বন্দোবস্ত করে। ওড়কলমী ফুলের নোলক পড়তে সে বড় ভালোবাসে। এরপরে ‘আম আঁটির ভেঁপু’ অংশ তাকে দেখা যায় তখন তার বয়স ১১ বছর। মর্ত্য সংলগ্নতা দুর্গার মধ্যে অত্যন্ত অনুপুঙ্খভাবে রক্ষা করেছেন ঔপন্যাসিক। প্রতিটি তুচ্ছ জিনিসের প্রতি তার অসীম আকর্ষণ ভাঙা আয়না নিয়ে সাজে,লক্ষীর চুবড়ির আলতা নিয়ে সাজসজ্জা করে। রানুর বিয়েতে টুনির মায়ের সোনার সিঁদুর কৌটা চুরি করে। সোনা বলে নয়, সিঁদুর কৌটা বলেই সে চুরি করেছিল।এরপর তার নীরেনের সঙ্গে বিয়ের স্বপ্ন, রেলগাড়ি দেখার স্বপ্ন অপূরণ থেকেই যায়। জীবনের পালা যেন অতি দ্রুত শেষ হয়ে আসছে তাই সেই সংকেত লেখক আগেই থেকেই দিলেন – ‘দুর্গা আজকাল যেন গাছপালা, পথঘাট, এই অতি পরিচিত গ্রামের প্রতি অন্ধি-সন্ধিতে অত্যন্ত বেশি করিয়া আঁকড়াইয়া ধরিতেছে’। এরপর শরতের প্রাতে চারিদিকে যখন আনন্দের সুর নিয়মিত খাদ্যাভাবে ও উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু হয় অসুস্থ দূর্গার। কত অপূর্ণ আশা নিয়ে সে চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে। উপন্যাসিক জানিয়েছেন, প্রথম খসরাই দুর্গা চরিত্রটির অস্তিত্ব ছিল না।। পরে তা সংযুক্ত করেছেন। উপন্যাসের প্রকৃতির একদিকে যেমন অপুর সুদূর ব্যাপ্ত চেতনা আছে তেমনি অন্যদিকে আছে দুর্গার মৃত্তিকা সংলগ্ন প্রকৃতি প্রীতি। দুর্গা না থাকলে এই আখ্যানের অনেকাংশই বাদ যেত। দুর্গা বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতি দুহিতার রূপকল্প হয়ে পাঠকমনে চির জাগরণ হয়ে থাকবে।
পথের পাঁচালী উপন্যাসে বিভূতিভূষণ মানব জীবনের আপাত তুচ্ছের মধ্যে মহতের উপস্থিতি অনুভব করেছেন। সর্বজয়া এদের মধ্যে ব্যতিক্রমী চরিত্র। এই ব্যাতিক্রম তার সনিষ্ট সংসারিকতায়। উপন্যাসে তার জীবনের তিনটি অধ্যায় বর্ণিত হয়েছে ‘বল্লালী বলাই’য়ে নববধূ সর্বজয়া, ‘আম আঁটির ভেঁপু’ অংশে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে দরিদ্রের গৃহে গৃহিণী সর্বজয়া এবং ‘অক্রুর সংবাদ’ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে জীবনযুদ্ধে নিষ্পেষিত ও পরিণত সর্বজয়া। দরিদ্র গৃহস্থের কন্যা সর্বজয়ার হরিহরের সাথে বিবাহের পর, হরিহর নিখোঁজ হয়ে পশ্চিমে চলে যায়। বহুদিন পরে গ্রামে ফিরে এসে সর্বজয়াকে ফিরিয়ে আনে নিজ গৃহে। একে তো দরিদ্রের কন্যা, তারপর স্বামীর সংসারের দারিদ্র এতে সে বড় নিষ্ঠুর ও রূঢ় ভাষিনী হয়ে ওঠে। ইন্দের ঠাকুরানের সাথে বচসা করে বাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং ইন্দিরের পথেই মৃত্যু হয়। স্বামী সন্তান নিয়ে ভরপুর সংসারী জীবনের সেই পর্বে ইন্দিরের অসহায়তা বোঝেনি। ‘আম আঁটির ভেঁপু’ অংশে সর্বজয়া ঘোরতর সংসারী। কন্যা দুর্গাকে শাসন, পুত্র অপুর প্রতি অপার স্নেহ ও পক্ষপাত এখানে তাকে নিতান্ত সাধারণী করে রেখেছে। গ্রামীণ সমাজের সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা সর্বজয়াকে মুখরা ও নিষ্ঠুর করে তুলেছে কন্যার প্রতি। আবার পাড়াপড়শির অপবাদে জবাব দিতেও সর্বদা তৎপর সে। কন্যা দুর্গার মৃত্যু বদলে দেয় তাকে। কন্যাশোক সে প্রকট করে তোলেনি। কিন্তু নিশ্চিন্তপুর ছেড়ে যাওয়ার তীব্র আগ্রহ, তার বেদনাবোধকেই জাগ্রত করে। অক্রুর সংবাদে কাশিতে স্বল্প দিনের স্বাচ্ছন্দের পর স্বামীর মৃত্যু, তীব্র দারিদ্র ও অসহায়তার মুখোমুখি হয় সর্বজয়া। এক ধনিপরিবারের রান্নার কাজে যোগ দেয় সে। সেখানে সর্বজয়া গৃহিণী থেকে হয়ে যায় অনাথা পরিচারিকা। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে সর্বজয়া গৃহিণী, জননী,সাধারণ নারীরূপে উপস্থাপিত। তার মধ্যে মাতৃত্বের বৈশিষ্ট্যেই সর্বাধিক লক্ষণীয়। সর্বজয়া নিঃসহায় বাঙালি মাতৃ চরিত্রের চিরকালীন প্রতিনিধি।
‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের প্রধান পুরুষ চরিত্র হরিহর। যার পরিচয় অপু ও দুর্গার পিতা এবং সর্বজয়ার স্বামী। ভবঘুরে স্বভাবের মানুষ,দারিদ্রতা তার নিত্য সঙ্গী। তথাপি নৈরাস্য তাকে স্পর্শ করে না। নির্লিপ্ত থাকে সবসময়, জীবিকা নির্বাহের সন্ধানে ছুটে বেড়ায় এই দেশ থেকে ওই দেশে। সাফল্য আসে কালে ভদ্রে। সংসারের প্রতি হরিহর এতটাই উদাসীন যে বিয়ের পর নববধূকে শ্বশুর বাড়িতে রেখে নিজে নিখোঁজ হয়ে যায়। এইকারনে সঠিক সময়ে দুর্গার মৃত্যুর সংবাদ পেতেও ব্যর্থ হয়। অবশেষে দুর্গার মৃত্যুর পরে তার মধ্যে একটু সম্বিত ফিরে আসে। ইন্দিরা ঠাকুরানে চরিত্র ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে একটি বিশেষ চরিত্র। তৎকালীন সমাজে কুলীন ব্রাহ্মণের সাথে বিয়ে হলেও সে তার স্বামীকে ঠিকমত মনে করতে পারে না কারণ তার স্বামীর সাথে তার কালে ভদ্র দেখা হতো। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে হরিহরের আশ্রিতা রূপে থাকে। তাকে যেন মনে নিশ্চিন্দিপুরের প্রেক্ষাপটে প্রাগৈতিহাসিক কালের এক নির্ভেজাল দলিল বা সাক্ষী। এছাড়াও এই উপন্যাসে আরো অনেক অপ্রধান চরিত্রে পরিচয় পাওয়া বাস ফেরিওয়ালা, ভুবন মুখুজ্যে, অন্নদা রায়, আশালতা, প্রসন্ন গুরু মশাই, দিনুপালিত, মাতো, স্বর্ণ গোয়ালিনী,বংকা, নেড়া, পুটু, টেপি সুরেশ ও সুনীল, লক্ষণ মহজন, বকুল, সখি ঠাকুরন, নাড়ুগোপাল, সতু, মোক্ষদা, অরুণা, লীলা, গিরীশ সরকার শম্ভুনাথ সিং, সতীশ বাবু, মাতাবিয়া ইত্যাদি।
● লেখকের দৃষ্টিকোণে পথের পাঁচালী:
ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণের রচিত ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে প্রকৃতিকে যেন মানুষের দোড় গড়ায় টেনে এনেছেন। যখন বাংলা উপন্যাসে বিষন্ন উদভ্রান্ত সমস্যাতাড়িত উৎক্রান্তির জন্য উন্মুখ যুবক কুলের নানা রেখা নানা পটে ফুটে উঠেছিল তখন বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীতে আমরা অপু ও দুর্গাকে পেলাম, যারা তাদের শিশুত্বের জন্য, বালক বালিকার বয়োক্রমের জন্য প্রত্যক্ষত সেই সময়ের উল্লেখিত সমস্ত তরঙ্গাভিঘাতের দ্বারা অস্পৃষ্ঠ। বাস্তববাদ নিয়ে তিনি তেমন মাথা ঘামাননি। তাঁর বিষয় ছিল জীবনসত্য এবং সেই জীবন সত্যের অশেষত্বকে অনুধাবন। সেই অশেষত্বের প্রেক্ষাপটে- “সেই স্থান সেই অসীমত্বের রোম বার্লিন লন্ডন এবং চিংড়ি পোঁতার খাল, নিশ্চিন্দিপুরের মাঠঘাট সমান হয়ে ওঠে।”
এই উপন্যাসের ব্যাপ্ততা নিয়ে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন –
”এই তিন খন্ডে বিভক্ত বৃহৎ উপন্যাসে একটি কল্পনাপ্রবণ আধ্যাত্ম দৃষ্টি সম্পন্ন জীবনের ক্রমাভিব্যক্তির মহাকাব্য নামে অভিভূত হইতে পারে। ইহার মৌলিকতা ও সরস নবীনতা বঙ্গ সাহিত্যের গতানুগতিকতার মধ্যে পরম বিস্ময়াবহ আবির্ভাব। প্রকৃতির বর্ণনা, শৈশব চিত্র ও বাস্তবতার স্তর বহিয়া আধ্যাত্মিকতার উতঙ্গ শৃঙ্গারহন এই ত্রিবিধ অনবদ্য ভাব পরিণতি বিভূতিভূষণের উপন্যাসে বরনীয় করিয়াছে।”অন্যদিকে উপন্যাসের আধুনিকতা নিয়ে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন-
“তৃতীয়-চতুর্থ দশকে বিভূতিভূষণ উপন্যাসকে নাটকীয় বা মহাকাব্যিক বা লিরিক্যাল করার জন্য ব্যস্ত ছিলেন না। প্রকৃতির অনুপুঙ্খ ও অপু-দুর্গার সমগ্রতাকে ধরে রেখে তিনি নতুন ফর্ম সৃষ্টি করলেন। তাদের পারস্পরিকতায় যে অনন্যতা সেটাই পথের পাঁচালী আধুনিকতা”।
‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে অপুর যে শৈশব বিকশিত হয়েছিল, পরবর্তীকালে ‘অপরাজিতা’ উপন্যাসে অপুর পরিণত জীবনে পরিচয় পাওয়া যায়।
আমার মতামত:
‘পথের পাঁচালী’ বিভূতিভূষণের সামাজিক উপন্যাস হলেও এটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের পর্যায়ে পড়ে। বিভূতিভূষণ পথের পাঁচালীতে প্রধান চরিত্র অপুর মধ্যে যেন স্বয়ং বিভূতিভূষণ নিজেকেই দেখতে পেয়েছেন। এছাড়াও অপুর মা সর্বজয় সম্পর্কে ঔপন্যাসিক তৃণাঙ্কর গ্রন্থে বলেছেন –
‘সর্বজয়ার একটা অস্পষ্ট ভিত্তি আছে- আমার মা’।
তাছাড়া বিভূতিভূষণের ছোট বোন ‘মনিকে’ তিনি দুর্গা বলে ডাকতেন, উপন্যাসেরমতোই বোনটি অল্প বয়সে মারা যায়। নিশ্চিন্তপুর গ্রাম হল বিভূতিভূষণের কথায়- ‘পথের পাঁচালীর গ্রাম্য চিত্রগুলি সবই আমার স্বগ্রাম ব্যারাকপুর’। অপুর মতো বিভূতিভূষণ প্রসন্নগুরু মহাশয়ের পাঠশালাতে পড়তে যেতেন। মহানন্দের বিধবা ভগিনী মেনকা দেবী ভ্রাতার সংসারে জড়িয়ে পড়েন, ইনিই উপন্যাসে ইন্দিরা ঠাকুরন। বিভূতিভূষণ বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির বুকে যে সমস্ত বালক, বৃদ্ধ, শিশুর ছবি এঁকেছেন তাদের মূল রস রূপকথার রস। সেখানে শিশুর মনের কৌতূহল ও কবির মতোই কল্পনার প্রলেপ দিয়ে বিভূতিভূষণ অনুকরণীয় ভাষায় এমন গ্রামীণ চিত্র এঁকেছেন, চিত্র হিসাবে তা অনবদ্য ও অনতিক্রমনীয়। ঔপন্যাসিক উপন্যাসের প্রকৃতি চেতনার সঙ্গে মূলত জোর দিয়েছেন কাল চেতনার। যেখানে সর্বজয়া ইন্দির ঠাকুরনের সঙ্গে বিশ্রী ব্যবহার করেছে এবং সেই ব্যবহারই ঘুরে ফিরে দেখা দিয়েছে কাশীবাসী সর্বজয়ার জীবনে। তিনি রূপকথার প্রিয় কৌতূহলের শিশু অপু ও দুর্গা দৃষ্টিতে সমস্ত কিছুকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে আমরা যেন হারানো শৈশব ও বাল্য স্মৃতির মধ্যে যেন আবার ফিরে যায়। বস্তুত বিশাল অরণ্য প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের রহস্যময় যোগাযোগের নিবিড় অনুভূতি পথের পাঁচালী উপন্যাসের এক প্রকার অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। এখানে আছে চেনা পৃথিবীর মধ্যে, পরিচিত মানুষের মধ্যে, দৈনন্দিন জীবনচেনা পৃথিবীর মধ্যে অপরিচিত মানুষের মধ্যে, দৈনন্দিন জীবন ধারনের মধ্যে, অচেনা অরূপ জগতের মধ্যে সৌন্দর্যময় ইঙ্গিত ও রহস্যময় ব্যঞ্জনা। সেই দিক দিয়ে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্য বিশেষ স্থান অধিকার করেছে।