নীলদর্পণ নাটক : সামাজিক প্রেক্ষাপট

কলমে – নম্রতা বিশ্বাস, এম. এ , বি. এড , পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়


        দীনবন্ধু মিত্রের আবির্ভাব হয়েছিল উনিশ শতকের মধ্যপর্বে , ১৮৩০-১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে। সেইসময় বাংলাদেশের নগরকেন্দ্রিক রেনেসাঁসের পাশ্চাত্যভিমুখী ঢেউয়ের তরঙ্গ দেখা দিয়েছিল শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে, তাঁরা নানাধরনের সাহিত্য আন্দোলন সম্পর্কে ভাবছিলেন ও উদ্দীপ্ত হচ্ছিলেন। দীনবন্ধু মিত্র তাঁর পূর্ববর্তী নাট্যকারদের অসম্পূর্ণতা ও দুর্বলতা অতিক্রম করে নতুন এক নির্মাণের পথ রচনা করেছিলেন, তাঁর রচনায় নিজস্ব শিল্পবোধ দিয়ে স্বতন্ত্র নাট্যকৌশলের রূপায়ণ লক্ষ করা যায়।

     বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সর্বপ্রথম দীনবন্ধু মিত্রকে পরিপূর্ণরূপে আবিষ্কার করেছিলেন “রায় দীনবন্ধু মিত্র বাহাদুরের জীবনী ও গ্রন্থাবলীর সমালোচনায়।”

দীনবন্ধু মিত্রের কৃতিত্ব বিশ্লেষণ করে সুনীল কুমার দে  লিখেছিলেন,
“নাট্যকার হাস্যরসিক হিসেবে বাংলা সাহিত্য দীনবন্ধুর একটি উচ্চ ও নিজস্ব স্থান আছে, যেখানে তাঁহার সমকক্ষ নাই বলিলেই চলে।”


আধুনিক নাট্যধারার প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমসাময়িক হয়েও দীনবন্ধু মিত্র অবশ্য মধুসূদন দত্তের প্রবর্তিত পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক নাট্যরচনার দিকে না গিয়ে বরং বাস্তবধর্মী সামাজিক নাট্যরচনায় নিজেকে মনোনিবেশ করেছিলেন। পরবর্তী কালে এই ধারায় দীনবন্ধু মিত্রের প্রতিভা বিশ্লেষণ করলে লক্ষ করা যায় তাঁর স্মরণীয় চারটি বিশেষত্ব সেগুলি হল-
◆ সমাজের অতি সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর চিন্তাভাবনা ও সমবেদনা।
◆ তাঁর, বিস্তৃত অভিজ্ঞতা বাঙালি জীবন, সংস্কৃতি ও রুচিবোধ সম্পর্কে।
◆ তাঁর সুগভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি ও সমাজ বাস্তবতাবোধ।
◆ হাস্য রস সৃষ্টির দক্ষতা।
দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী ঘাটলে দেখা যায় তাঁর জন্ম হয়েছিল উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার চৌবেরিয়ায়। তাঁর জন্মের সময় অবশ্য এই চৌবেরিয়া গ্রামটি নদীয়া জেলার অংশ ছিল। দীনবন্ধু মিত্রের বাবা – মা অবশ্য তাঁর নাম রেখেছিলেন গন্ধর্ব নারায়ন মিত্র। দরিদ্র পরিবারের সন্তান দীনবন্ধু মিত্রের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গ্রাম্য পাঠশালায় সেখানে তিনি কিছুদিন পাঠগ্রহণ করেছিলেন তারপর দীনবন্ধু মিত্রকে তাঁর বাবা জমিদারের সে্রেস্তার কাজে নিযুক্ত করে দেন। দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ফলে তিনি কলকাতায় পালিয়ে আসেন এবং তাঁর পিতৃব্যের গৃহে বাসন মেজে লেখাপড়া চালান। এই সময়তেই গন্ধর্ব নারায়ন মিত্র নিজের নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র এবং জেমস লঙের অবৈতনিক বিদ্যালয়ে শুরু করেন পড়াশোনা। পরে কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল (বর্তমানে হেয়ার স্কুল) থেকে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি লাভ করেন এবং হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ ) ভর্তি হন। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে আবার উচ্চতর পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন এবং তৃতীয় শ্রেণি থেকে সিনিয়র বৃত্তি লাভ করেন ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে। দীনবন্ধু মিত্র প্রত্যেকটি পরীক্ষাতেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সর্বোচ্চ স্থান  অধিকার করেছিলেন।
দীনবন্ধু মিত্র ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ১৫০ টাকা বেতনে পাটনায় পোস্টমাস্টারের চাকুরীতে নিযুক্ত হন। ক্রমে তাঁর পদোন্নতি হয় এবং পরবর্তীতে তিনি কলকাতায় সুপারিনটেনডেন্ট পোস্টমাস্টারে নিযুক্ত হয়েছিলেন। দীনবন্ধু মিত্রকে লুসাই যুদ্ধের সময় কাছাড়ে প্রেরন করা হয়েছিল ডাকবিভাগের কাজে এবং সরকার তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে  ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি দান করেছিলেন।

       দীনবন্ধু মিত্রের সাহিত্য‌‌ ক্ষেত্রে অবদান শুরু হয় ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। পরে ‘সংবাদ সাধুরঞ্জন’ পত্রিকাতেও লিখতে শুরু করেন তিনি। দীনবন্ধু মিত্রের অবদান সবথেকে বেশি যে সাহিত্য কর্মে তা হল নাটক।

তাঁর রচিত নাটকগুলো হলো –
স্বদেশ প্রেমমূলক  – ‘নীলদর্পণ’: রচনা কাল ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ।
প্রহসনধর্মী নাটক – ‘সধবার একাদশী’: রচনাকাল ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ, ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’: রচনাকাল – ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ, ‘জামাই বারিক’: রচনাকাল ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দ, ‘লীলাবতী’ : রচনাকাল – ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ।
রোমান্টিক নাটক – ‘নবীন তপস্বিনী’ : রচনাকাল- ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ, ‘কমলে কামিনী’: রচনা কাল – ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ।

    বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ পরিচিত‌ নাটক হল দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ এটি তাঁর প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক। স্বদেশিকতা, নীল বিদ্রোহ ও সমসাময়িক বাংলার সমাজব্যবস্থাকে উক্ত নাটকে‌ তুলে ধরা হয়েছে। এই নাটকটি তিনি রচনা করেছিলেন নীলকর-বিষধর-কাতরপ্রজানিকর-ক্ষেমঙ্করেণ-কেনচিৎ-পথিক ছদ্মনামে ‌। কিন্তু লক্ষ করা যায় এই নাটকই তাঁকে খ্যাতি ও সম্মানের চূড়ান্ত শীর্ষে উন্নীত করেছিল।

অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় –
“নাটক প্রকাশিত হলে এবং এর ইংরেজি অনুবাদ প্রচারিত হলে একদিনেই এ নাটক বাঙালিমহলে যতটা প্রশংসিত হয়েছিল, শ্বেতাঙ্গমহলে ঠিক ততটাই ঘৃণিত হয়েছিল। এই নাটক অবলম্বন করে বাঙালির স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সূচনা, এই নাটক সম্বন্ধে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ও রায়তদের মধ্যে মৈত্রীবন্ধন স্থাপিত হয়, এর মধ্যে দিয়েই শ্বেতাঙ্গ নীলকরদের বর্বর চরিত্র উদঘাটিত হয় ।”

      ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অনুবাদ ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। স্বদেশ ও বিদেশে নীলকরদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন শুরু হয় এই নাটকের প্রভাবে। ফলে সরকার নীল কমিশন ও ইন্ডিগো কমিশন বসাতে বাধ্য হন এবং আইন পাশ করিয়ে নীলকরদের বর্বরতা বন্ধ করা হয়। পরবর্তীকালে ‘আঙ্কল টমস্ কেবিন’ গ্রন্থের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘নীলদর্পণ’ নাটকটির তুলনা করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি বাঙালি ‌সমাজ ও বাংলা‌ সাহিত্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। সমাজের সাধারণ জনগণদের জীবনকথা এমনভাবে উক্ত নাটকটির প্রকাশিত হয়েছে যে অনেকের মতে ‘নীলদর্পন’ নাটকটি ছিল প্রথম গণনাটক। এমনকি জাতীয়তাবোধ জাগরণের পিছনে এই নীলদর্পণ নাটকই ছিল প্রথম সাহিত্যের অস্ত্র।

       নীলচাষের ফলে গ্রাম্য সমাজ ব্যবস্থা কীভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল তার চিত্র ফুটে ওঠে ‘নীলদর্পণ’ নাটকে। দীনবন্ধু মিত্র যেহেতু পোষ্টমাস্টার ছিলেন ফলে বিভিন্ন গ্রামের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। উনিশ শতকে গ্রামীণ সমাজে কৃষকদের কাছে নীলচাষ  বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছিল। শুধু যে সাধারণ কৃষকদের বাধ্য করা হয়েছিল তা নয় বরং সম্ভ্রান্ত জমিদার ও সম্পন্ন চাষিদেরকেও অত্যাচারী নীলকর সাহেবরা বাধ্য করে তুলেছিলেন নীল চাষের জন্য। নীলদর্পণ নাটকে লক্ষ করা যায় স্বরপুর গ্রামের গোলকচন্দ্র বসুর মতো সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবার নীলকর সাহেবদের চাপে নীলচাষ করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পরেছিলেন। নাটকে দেখা যায়, গোলকচন্দ্র বসুর ছেলে নবীন মাধব নীলকরদের কথা মতো পঞ্চাশ বিঘা জমিতে নীল চাষ করলেও বেগুনবাড়ির নীলকররা  তাঁর উপযুক্ত মূল্য দেন নি এবং বারে বারে পাওনা টাকা চাইতে যাওয়ায় নবীন মাধবকে সামনের বছরের জন্য ষাট বিঘা জমিতে নীল চাষ করার নির্দেশ দেওয়া হয় –
“…… সাহেবর কথা সেই, তিনি বলেন পঞ্চাশ টাকা লইয়া ষাট বিঘা নীলের লেখাপড়া করিয়া দাও, পরে একেবারে দুই সনের হিসাব চুকাইয়া দেওয়া যাবে।”
সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের পাশাপাশি রাইয়তদেরকেও বিভিন্ন ভাবে অত্যাচার করা হত। নাটকে লক্ষ করা যায় সাধুচরণ ও রাইচরণ নামে ভাতৃদ্বয়কে এই নীলচাষ নিয়ে নির্মম অত্যাচার করা হয় যখন তাঁরা নীলচাষ করতে অস্বীকার করেন –
“শালা কোন‌ মতেই শোনলে না, জোর করেই দাগ মারলে। সাঁপোলতলার পাঁচ কুড়ো ভুঁই যদি নীল গ্যাল,  তবে মাগ্ ছেলের খাওয়াব কি !”
এমনকি নাটকে লক্ষ করা যায় সাধুচরণ ও রাইচরণের ভালো ধানীতে নীলকর সাহেবরা দাগ দিয়ে দেন এবং তাঁরা এর প্রতিবাদ করলে তাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়-
“বাঁদ, রেয়ে শালাকে বাঁদ ।”

      ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে নীলকর সাহেবদের অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেটের অধিকার দেওয়া হলে তাঁরা তাঁর অপব্যবহার করেছিলেন উক্ত নাটকে তার দৃশ্য লক্ষ করা যায়। নীলকর সাহেবরা নবীন মাধবকে শাস্তি দেওয়া স্বরূপ তার বাবা গোলকচন্দ্র বসুকে ১১ আইনে গ্রেপ্তার করেন –
“হুকুম হইল যে আসামীর নিকট হইতে দুইশত টাকা আইনে দুইজন জামিন লওয়া হয় এবং সাফাই সাক্ষীদিগের নামে রীতিমত সাফিনা জারি হয়।”
এরফলে দেখা যায় গোলকচন্দ্র বসু ভেঙে পরেন এবং তিনি তিনদিন অনাহারে থাকেন এবং পরবর্তীতে আর মনের দুঃখ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেন –
“আহা ! পিতার উদ্বন্ধনে মৃত্যু হইয়াছে। আমি যে পিতার মুক্তির সম্ভাবনা ব্যক্ত করিতে আসিতেছি ।”
এরপরই লক্ষ করা যায় নবীন মাধবদের পরিবারে চরম দুর্দশার সৃষ্টি হয়। গোলকচন্দ্র বসুর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে নবীনমাধব যায় ‘বড় বাবু’-এর কাছে পুষ্করিনীর পাড়ের জমিতে নীল চাষ যাতে না করা হয় – “হজুর, আপনাকে পঞ্চাশ টাকা সেলামি দিতেছি, এ স্থানটায় নীল করবেন না, আর যদি এই ভিক্ষা না দেন, তবে টাকা লইয়া গরীব পিতৃহীন প্রজার প্রতি অনুগ্রহ করিয়া শ্রাদ্ধের নিয়মভঙ্গের দিন পর্য্যন্ত বুনন রহিত করুন।”
কিন্তু বড়ো বাবু তাঁর অনুরোধ না শুনে বরং তাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলেন – “পায়ের জুতা বড়বাবুর হাঁটুতে ঠেকাইয়া কহিল, “তোর বাপের শ্রাদ্ধের ভিক্ষা এই।” এরপর নবীনমাধব সাহেবকে বক্ষস্থলে পদাঘাত করলে সাহেবের শড়কিওয়ালারা নবীন মাধবকে খুব মারে তাঁর ফলে তিনি অচৈতন্য হয়ে পরেন এবং অনেক চিকিৎসা করেও তাঁর জ্ঞান ফেরে না এবং পরবর্তীতে দেখা যায় তাঁর মৃত্যু ঘটে। স্বামী ও পুত্রের মৃত্যুতে নবীনচন্দ্রের মা সাবিত্রী দেবী মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পরেন এবং তিনি নবীনমাধবের মৃত্যু শরীর নিয়ে এমন ভাবে তাঁর সেবাযত্ন করতে থাকেন যেন তিনি ছোটো কোলের শিশু সেই সময় বিন্দুমাধবের পত্নী সরলতা দেবী সেই স্থানে উপস্থিত হলে সাবিত্রী দেবী সরলতাকে বিদেশি মেমসাহেব ভেবে হত্যা করেন মানসিক ভারসাম্যহীনতার বশে-
“পাজি বিটি, যমসোহাগি, এই তোর পেয়ে ফেলি – (গলায় পা দিয়া দণ্ডায়মান) আমার কর্ত্তারে খেয়েচো, আবার আমার দুধের বাছাকে খাবার জন্যে তোমার উপপতিকে ডাকচো। মর্ মর্ মর্ মর্ – গলার উপর নৃত্য । ”
পরবর্তীতে নাটক দেখা যায় বিন্দুমাধবের প্রবেশ ঘটে এবং তাঁর চেষ্টায় সাবিত্রী দেবীর জ্ঞান ফিরলে তিনি নিজের কৃতকর্ম বুঝতে পারেন যে তিনি অচেতন ভাবে সরলতাকে হত্যা করেছেন এরপর তিনি নিজেও মৃত্যুবরণ করেন – “যাহা বলিলাম তাহাই ঘটিল। মাতার জ্ঞানসঞ্চারেপ্রাণনাশ হইল।” নীলকর সাহেবদের অত্যাচার এতটাই প্রবল ছিল যে তার প্রভাবে একটি পরিবার কি ভাবে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে তারই নিদর্শন এই গোলকচন্দ্র বসুর পরিবার।
নাটকে আরো দেখা যায় নীলচাষের বিরোধীতা করার জন্য তোরাপ মিঞাকে এবং আরো চারজন কৃষকদের বেগুনবাড়ির নীলকুঠিতে ধরে এনে বেধে রেখে নির্মম ভাবে অত্যাচার করা হয় –“শ্যামচাঁদেল ঠ্যালা বড় ঠ্যালা,”

       নীলকর সাহেবদের নির্যাতন ও লালসার শিকার শুধুমাত্র যে কৃষকেরা হতেন, তা নয় তাঁদের পরিবারের মেয়েরাও শিকার হতেন। নীলকুঠিতে কর্মরত কর্মচারীরা গ্রামের ভালো মেয়েদের সন্ধান দিতে পারলে ভালো ‘পেস্কারি’ পেতেন। – “আপনার বুন দিয়ে বড় পেস্কারি পেলাম, তা এরে দিয়ে পাব; মালটা ভাল, দেখা যাক।”
নাটকের ‘ তৃতীয় অঙ্কের ’ তৃতীয় গর্ভাঙ্কে লক্ষ করা যায় ছোট সাহেব রোগের কাছে তাঁর প্রতিপালিত পদী ময়রানী ক্ষেত্রমণিকে নিয়ে আসেন এবং ক্ষেত্রমণি সন্তান সম্ভবা জেনেও রোগ সাহেব তাঁর উপর শারীরিক নির্যাতন চালায় । নবীন মাধবের জন্য ক্ষেত্রমণি সেই যাত্রা বেঁচে গেলেও পরবর্তীতে দেখা যায় নাটকে ক্ষেত্রমণির শেষ পর্যন্ত মৃত্যু ঘটে। – “ওমা ! মোর কপালে কি হলো ! ওমা ! হারাণের রূপ ভালেবো কেমন করে, বাপো ! বাপো ! – ও ক্ষেত্র, ক্ষেত্রমণি ! মা আর কি কথা কবা না মা মোর, বাপো, বাপো বাপো ! ”
ছোটো সাহেব রোগ ক্ষেত্রমণির সঙ্গে যে শ্লীলতাহানি করেছিলেন তাঁর মধ্যে দুটি শক্তির সংঘর্ষ লক্ষ করা যায় – ১) প্রবল অত্যাচার করার শক্তি অন্যটি ২) দুর্বলের আত্মরক্ষা করার শক্তি। এখানে নীলকর ইংরেজ নয় এবং ক্ষেত্রমণিও কেউ না বরং সমাজে চিরকাল দুর্বলের উপর শক্তিশালী জাতির যে অত্যাচারের প্রথা সেটাই তুলে ধরা হয়েছে। এই দৃশ্যটি একটি সমসাময়িক সামাজিক অবস্থাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হলেও এটি একটি চিরন্তন সত্যেরই স্বরূপ বলা যায় । ক্ষেত্রমণির মৃত্যুতে রেবতীর যে বিলাপ তাতে শোনা যায় – “মারে মুই কনে যাবরে! সাহেবের সঙ্গি থাকা যে মোর ছিল ভাল মারে ! মুই মুখ দেখে জুড়োতাম মারে ! হো, হো, হো ! ”
এই উক্তির মধ্যে লুকিয়ে আছে এক গভীর সত্য যা মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক। আপাত দৃষ্টিতে এই উক্তি ঘৃণাযুক্ত। যদিও ক্ষেত্রমণির মৃত্যু হয়েছে তাঁর সতীত্ব রক্ষার্থে কিন্তু একজন মায়ের কাছে তাঁর সন্তানই সবকিছু। বলা যেতে পারে দীনবন্ধু মিত্রের গভীর জীবনদৃষ্টির ফলই এই দৃশ্য।

        উপরিউক্ত চিত্র ছাড়াও ‘নীলদর্পণ’ নাটকে দেখা যায় কৃষকদের নিজেদের ফসলের উপর নির্ভরশীলতা গোলাভরা ধান, পূজার সময় উৎসব প্রভৃতি। এছাড়া গোলকচন্দ্র বসুর অন্দর মহলের পারিবারিক দৃশ্য সিকা বোনা, স্বামীর কাছে স্ত্রীর প্রেরণ, শাশুড়ি মায়ের সেবা, নিত্য ঘরকন্নার মাঝে সুখী পরিবারের প্রতিদিনের দিনযাপন ফুটে এসেছে। এছাড়া এই নাটকের মধ্য দিয়ে সেই সময় গ্রাম্য সমাজের কথ্য ভাষার যে রূপ তার পরিচয় ঘটে। গ্রাম বাংলার আচার, যৌথ পরিবার, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য, সামাজিক মিলন প্রমুখ নানা দিকগুলোর পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু এইসবের থেকে নীলচাষের ফলে যে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল তার তাৎপর্যই বেশি। নীলচাষ কিভাবে গ্রামীন জনজীবনকে বিধ্বস্ত করে তুলেছিল তাঁরই জীবন্ত সমাজদর্পণ এই ‘নীলদর্পণ’ নাটক।