গোরা উপন্যাসের আলোচনা

কলমে- পূজা দাস , এম.এ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)


     শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যের ধারায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – এই নামটি তারকার মতো উজ্জ্বল। তিনি জীবনকে দেখেছেন সমগ্র প্রকৃতির মধ্য দিয়ে, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ নিজের অস্তিত্বের মধ্যে প্রাণ ও প্রকৃতির এই আদি ও অকৃত্রিম সম্পর্ককে উপলব্ধি করেছেন। প্রকৃতি হয়ে উঠেছে তাঁর কাছে এক প্রাণময় সত্তা। পদ্মা তীরে জমিদারি কাজ দেখাশোনার সময়ে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি ও মানুষের যে নিবিড় সান্নিধ্যে পেয়েছিলেন, তাঁর মধ্যেই সম্প্রসারিত হয়েছিল তার সত্তা। তিনি বিস্ময়কর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করেছেন প্রকৃতির বিচিত্রলীলার মধ্যে মানুষের সাধারণ জীবনযাপন। কবির ‘জীবন দেবতা’ হয়ত এই অভিযানের নিরুদ্দেশের পথে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে। জীবন দেবতার মধ্যেই যে তিনি ‘আমি’র যে একটা অখন্ড সূত্রকে পেয়েছিলেন। সেই অখন্ড সূত্র সকল ভেদ- বিভেদ দূর করে মানব আত্মাকে অসীমের প্রতি ধাবমান করে তুলেছে এবং এক অতি গভীর বিশ্ববোধে পূর্ণ করে তুলেছে।

‘মানুষের ধর্ম’ নামক এক বক্তৃতায় তিনি বলেন –

“মানুষ আছে তার দুই ভাবকে নিয়ে, একটা তার জীব ভাব,আর একটা বিশ্বভাব। জীবন আছে আপন উপস্থিতিকে আঁকড়ে, জীব চলেছে আশু প্রয়োজনের কেন্দ্র প্রদক্ষিণ করে। মানুষের মধ্যে সেই জীবকে পেরিয়ে গেছে যে সত্তা সে আছে আদর্শকে নিয়ে। এই আদর্শ অন্নের মতো নয়, বস্ত্রের মতো নয়। এ আদর্শ একটা আন্তরিক আহ্বান, এ আদর্শ একটা নিগূঢ় নির্দেশ”

– আর এই আদর্শের কথাই রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের মূল কথা।

‘গোরা’ উপন্যাসের পরিচয় :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ উপন্যাসটি ১৮৮০ দশকে ব্রিটিশ রাজত্বকালের সময় কলকাতার পটভূমিতে লেখা। উপন্যাসটির ধরন হল রাজনীতি ও ধর্ম নিয়ে দার্শনিক বিতর্কে সমৃদ্ধ উপন্যাস। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় সমাজে নানা টানাপোড়েন, নানা চিন্তা ও আদর্শের স্রোত এবং বিপরীত স্রোতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, নির্মিত হচ্ছিল নানা দ্বান্দ্বিক প্রতিক্রিয়া। সেই অন্বেষণ থেকেই দেশ, জাতি, জাতিসত্তার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনে রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’কে সৃষ্টি করলেন।

৹ এই উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের ১৩টি উপন্যাসের মধ্যে পঞ্চম স্থান অধিকারী এবং সবচেয়ে দীর্ঘতম।
৹ এই উপন্যাসের পৃষ্ঠা সংখ্যা প্রায় ৬২৪টি। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের যে সমস্ত উপন্যাস আছে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বমূলক জটিল উপন্যাস হল ‘গোরা’ উপন্যাসটি।
৹ উপন্যাস্যাটি রবীন্দ্রনাথ ৪৭ থেকে ৪৯ বছর লিখেছিলেন
৹ এবং গোরা উপন‍্যাসটি প্রথমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় 1907 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1909 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘প্রবাসী’পত্রিকায়। 
৹ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গোরা উপন্যাসটি উৎসর্গ করেন পুত্র রথীন্দ্রনাথকে।

লেখক পরিচিতি:
      রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন কাহিনি যতই বলা যায় যেন শেষ হতেই চায় না। এই মহৎ ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন ৭ই মে১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে (২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দে) জোড়াসাঁকোর ৬ নম্বর দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের পারিবারিক বাসভবনে। রবীন্দ্রনাথের পিতা ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা সারদাসুন্দরী দেবী। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতামাতার ১৪ তম সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠতম। ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য,পত্রিকা,সংগীত ও নাট্য অনুষ্ঠানের এক পরিবেশে প্রতিপালিত হয়েছেন। জীবনের প্রথম ১০ বৎসর পিতার সাথে পরিচিত হবার সুযোগই পাননি রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছে মূলত চাকরদের মহলের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থেকে যা জানা গেছে তার ‘জীবন স্মৃতি’ নামক প্রবন্ধ থেকে। ফলত বাইরের জগত ও প্রকৃতির সঙ্গে সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন বালক রবীন্দ্রনাথ। এরপর তিনি বিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করেন, অবশ্য বিদ্যালয়ের ধরা বাঁধা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে তিনি আবদ্ধ থাকেন নি। প্রথমে নর্ম্যাল স্কুল, তারপরে একে একে বেঙ্গল একাডেমি, ওরিয়েন্টাল সেমিনারি এবং তার পরে শেষে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে কিছুকাল পড়াশোনার পর তিনি বিদ্যালয়ে যেতে অস্বীকার করেন। তার কাছে বিদ্যালয়ের শিক্ষা ছিল নিষ্প্রাণ। তিনি আমাদের সাহিত্যের সাহিত্যকে নানা দিক দিয়ে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। তিনি লেখার প্রেরণা পেতেন বৌদি কাদম্বরী দেবীর কাছ থেকে। এরপর ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ভবতারিণী দেবী ওরফে মৃণালিনী দেবীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর পাঁচ সন্তানের পিতা-মাতা ছিলেন।রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত কবি এই কবিতার প্রকাশ ঘটে মূলত আট বছর বয়স থেকে। তবে তিনি বাঙালির কাছে সংগীত স্রষ্টা হিসেবেও পরিচিত। এছাড়াও তিনি উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, প্রবন্ধও রচনা করেছেন।
তাঁর মৌলিক কাব্যের সংখ্যা ৫২টি, উপন্যাস ১৩টি, ছোটগল্প ৯৫টি, প্রবন্ধ 36টি, এবং নাটক ৩৮টি। তাছাড়া তাঁর সামগ্রিক চিঠিপত্র ১৯টি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি ‘গীতাঞ্জলি’ রচনার জন্য ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ কর্তৃক নোবেল পুরস্কার পান।’রবীন্দ্রনৃত্য’ তাঁরই প্রবর্তিত নৃত্যশৈলীর মধ্যে অন্যতম।
তাঁর কাব্যগ্রন্থ গুলি হল- ‘মানসী'(১৮৯০), ‘চিত্রা'(১৮৯৬), ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪), ‘চৈতালি'(১৮৯৬), ‘কল্পনা'(১৯০০), ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০), ‘নৈবেদ্য'(১৯০১),’খেয়া'(১৯০৬),’গীতাঞ্জলি'(১৯১৩), ‘বলাকা’ (১৯১৬), ‘পুনঃশ্চ’ ‘আরোগ্য'(১৯৪৮), ‘জন্মদিন'(১৯৪৮),’শেষ লেখা’ (১৯৪৮) ইত্যাদি।
ছোট ছোটগল্প গুলি হল- কঙ্কাল, নিশীতে, মনিহারা, ক্ষুধিত, ক্ষুধিতপাষাণ, স্ত্রীরপত্র, নষ্টনীড়, কাবুলিওয়ালা প্রভৃতি।’লিপিকা’ ও ‘তিন সঙ্গী’ গল্প গ্রন্থে নতুন আঙ্গিকে গল্প রচনা করেছেন।
উপন্যাস গুলি হল- ‘বৌ- ঠাকুরানীর হাট’, ‘রাজর্ষি'(১৮৮৭), ‘চোখের বালি'(১৯০৩), ‘নৌকাডুবি'(১৯০৬), ‘গোরা'(১৯১০), ‘যোগাযোগ’ (১৯২৯), ‘শেষের কবিতা'(১৯২৯) প্রভৃতি।
প্রবন্ধ পত্র ও সাহিত্য গুলি হল- ‘ভারতবর্ষ'(১৯০৬), ‘ইতিহাস'(১৯৫৫), ‘সাহিত্যের পথে'(১৯৩৬), ‘লোক সাহিত্য'(১৯০৭), ‘আধুনিক সাহিত্য’ (১৯০৭) ইত্যাদি।
নাট্য সাহিত্য গুলি হল- গীতিনাট্য গুলি হল- ‘বাল্মীকির প্রতিভা’ (১৯৮১), ‘রাজা ও রানী’ (১৮৮৯), ‘বিসর্জন'( ১৮৯০), ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১৮৯২), ‘মালিনী'(১৮৯৬) ইত্যাদি। কাব্য নাট্য – ‘গোড়ায় গলদ’ (১৮৯২),’মালিনী'(১৮৯৬), ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ (১৮৯৭) ‘হাস্যকৌতুক’ (১৯০৭) ইত্যাদি।
রূপক সাংকেতিক নাটক- ‘শারোদউৎসব’ (১৯০৮),’ডাকঘর'(১৯১২), ‘অচলায়তন’ (১৯১২), ‘মুক্তধারা'( ১৯২২), ‘রক্তকরবী’ (১৯২৬), ‘তাশের দেশ'(১৯৩৩),’কালের যাত্রা'(১৯৩২), ইত্যাদি। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ১৯১৫টি গান রচনা করেছেন,তাঁর রচিত গান সংকলিত হয়েছে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে। জীবনের শেষ চার বছর কেটেছিল ধারাবাহিক শারীরিক অসুস্থতার মধ্য দিয়ে ,শয্যাশায়ী অবস্থায়। মৃত্যুর ৭ দিন আগে পর্যন্ত তিনি সৃষ্টি করে চলেছিলেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১খ্রিস্টাব্দের ৭ই আগস্ট (২২শে শ্রাবণ ১৩৪৭ বঙ্গাব্দে) ৮০ বছর বয়সে জোড়াসাঁকোর  বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

◆ ‘গোরা’ উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত বিষয়বস্তু :
      ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের ধর্ম আন্দোলন, স্বদেশ প্রেম ও নারীর মুক্তির চিন্তার পটভূমিকায় এই আখ্যান গড়ে উঠেছে। প্রথম জীবনে কৃষ্ণদয়াল মদ মাংস খেয়ে এবং ইংরেজদের ঢঙে প্রায় বেপরোয়াভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কৃষ্ণদয়াল দুবার বিবাহ করে। প্রথম পক্ষের স্ত্রী একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেই মারা যান। প্রথম পক্ষ স্ত্রীর মৃত্যুর ৬ মাস পর কৃষ্ণদয়াল কাশী নিবাসী সার্বভৌম মহাশয়ের পিতৃহীনা আনন্দময়ীকে বিবাহ করেন। বিয়ের দীর্ঘ দিন পরে আনন্দময়ী নিঃসন্তান ছিলেন। ইতিমধ্যে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয় সেই সময় কৃষ্ণদয়াল দু একজন উচ্চপদস্থ ইংরেজ সাহেবের প্রাণ রক্ষা করে সুনাম ও অর্থ লাভ করে। এই সময় এক আইরিশ ম্যানের স্ত্রী একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেই মারা যায়। তখন নিঃসন্তান আনন্দময়ী এই সন্তানটিকে পরম স্নেহে কোলে তুলে নেয়, যার পরিচয় উপন্যাসে ‘গোরা’।
       সিপাহী বিদ্রোহ প্রশমিত হবার পর কৃষ্ণদয়াল সপরিবারে কাশী থেকে কলকাতায় চলে আসে। তারপর আনন্দময়ী ও কৃষ্ণদয়াল ঠিক করলেন যে জন্মসূত্রে গোরা বিদেশি হলেও তাকে ব্রাহ্মণ সন্তানের মতোই সমস্ত সংস্কার দিয়ে মানুষ করে তুলবেন। গোরা যখন একটু বড় হল তখন সে অত্যন্ত দুরন্ত হয়ে উঠলো, যেন সবার সাথে সর্দারি করা তার প্রধান কাজ।  যখন আরো একটু বড় হলো তখন তার বাবার সঙ্গেই নানা বিষয়ে বিরোধ বাঁধাতে লাগলো। কৃষ্ণ দয়াল প্রথম জীবনের ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তারপর কলকাতায় ফিরে এসে তিনি হিন্দু ধর্মের আচারে ব্যবহারে এতটাই রক্ষণশীল হয়ে পড়ে যে- নিজের পালিত পুত্র গোরা বিদেশি হওয়ায় তাকে ম্লেচ্ছ মনে করতেন এবং সর্বদা তার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলতেন। অন্যদিকে স্ত্রী আনন্দময়ী দাসী খ্রিস্টান লছমিয়া খ্রিস্টান হওয়াই কৃষ্ণদয়াল স্ত্রীর ছোঁয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন। কৃষ্ণদয়াল যখন ব্রাহ্ম ধর্ম ত্যাগ করে, ঠিক সেই সময়টাতে কেশব চন্দ্রের বক্তৃতা শুনে গোরা ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। বিশেষত জাতপাত, ছোঁয়াছুঁয়ি, শুচিতা ইত্যাদি বিষয়গুলিকে গোড়া মূঢ়তা বলে মনে করে। এইসব নিয়ে পিতা পুত্রের মধ্যে ভয়ংকর তর্ক বিতর্ক চলে, আনন্দময়ী ক্ষতে প্রলেপ লাগিয়ে পিতা পুত্রের সম্পর্ক কোনো রকমের টিকিয়ে রাখে। এই সময় হিন্দু বিরোধী কাজকর্ম ও আচার ব্যবহার দেখে চিন্তিত গোরার পিতামাতা সিদ্ধান্ত নেন গোড়াকে প্রকৃত হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা দানের জন্য শাস্ত্র শিক্ষার আয়োজন করবে। এরপর  বিদ্যাবাগীশ মহাশয়ের উদারতা ও বেদান্ত দর্শন গোরার মনের গভীর পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং ধীরে ধীরে গোরা পিতার থেকে আরও বেশি গোঁড়া হিন্দুতে পরিণত হয়ে ওঠে। তারপর গোড়ার অতিরিক্ত হিন্দুয়ানীতে তার পিতা-মাতা আবার চিন্তিত হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণদয়াল ঠিক করেন, গোরার বিবাহ দেবেন। এরপর ঘটনার নানা উত্থান পতন ঘটে-পরেশ বাবুর বাড়িতে গোরা ও বিনয়ের আগমন, গোরার গ্রাম্য দর্শন, বিনয় ও ললিতার বিবাহ, গোরার প্রায়শ্চিত্ত ও আত্মপরিচয়। উপন্যাসের শেষে দেখা যায় আত্মপরিচয় জানার পর গোরার মধ্যে এক নতুন বোধের জাগরণ ঘটে সে সে জানতে পারে –
“তার মা নাই, বাপ নাই,দেশ নাই, জাতি নাই ,নাম নাই, দেবতা নাই।” 
তার সমস্ত অহংকার সংস্কার চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়, যে মাকে সে এতদিন শুচিতার জন্য দূরে ঠেলে ফেলে রেখে দিয়েছিল, সেই মাকেই কাছে টেনে নিয়ে বলে –
“মা, তুমিই আমার মা, যে মাকে এতদিন খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম, তিনি আমার ঘরের মধ্যেই বসেছিলেন। তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই। তুমি শুধু কল্যাণের প্রতিমা।  তুমি আমার ভারতবর্ষ…..।”

গোরা উপন্যাসের চরিত্র :
‘গোরা’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হল ‘গোরা’। তার জন্ম হয় সিপাহী বিদ্রোহের সময় ১৮৫৭ সালে।  উপন্যাসের সে কৃষ্ণদয়াল ও আনন্দময়ীর সন্তান হলেও, সে ছিল একজন আইরিশ মায়ের সন্তান।  যুদ্ধের সময় কোন এক আইরিস পরিবার কৃষ্ণদয়ালের বাড়িতে আশ্রয় নেয়, সেই আইরিশ মহিলাই সন্তান প্রসব করে মারা যান, আনন্দময়ী নিঃসন্তান থাকার কারণে সেই আইরিশ সন্তানকে মাতৃস্নেহে বুকে টেনে নেয়,এই সন্তান‌ই হল ‘গোরা’ পুরো নাম গৌরমোহন। গোরা চরিত্রে যেন সমগ্র জীবনের বিপুল প্রতিবিম্ব পড়েছে -যেন বৃহৎ নদীর মত চলমান এক জীবন প্রবাহের উপর বিরাট আকাশের প্রতিফলন ঘটেছে। সমগ্র উপন্যাসটি পর্যালোচনা করলে গোরার হৃদয় বৃত্তির তিনটি দিক লক্ষ্য করা যায় –  ১) আনন্দময়ীর সাথে তার সম্পর্ক, সেখানে মাতৃভক্তির উজ্জ্বল প্রকাশ।
২) বিনয়ের প্রতি তার প্রগাঢ় প্রীতি এবং
৩) সুচরিতার সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্ক। এই সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই গোরা নিজের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মূর্তিমান বিদ্রোহের রূপ নিয়ে সুচরিতার সান্নিধ্যে এসেছে। এই পরিচয়েই তার অবচেতন মনে প্রথম প্রেমের অঙ্কুর দেখা দিল। তাই বিনয় যখন পরিপূর্ণ আবেগ নিয়ে তার মনের রুদ্ধ দ্বার মুক্ত করল, তখন গোরাও যেন তার প্রভাব সহসা অস্বীকার করতে পারল না। এইখানে ঔপন্যাসিক গোরা মনোবিশ্লেষণ করলেন- “মানবহৃদয়ের এমন একটা সত্য পদার্থ, এমন একটা প্রবল প্রকাশ এমন করিয়া গোরার সামনে আসিয়া পড়ে নাই”।
উপন্যাসের ২১তম পরিচ্ছেদে রবীন্দ্রনাথ গঙ্গা তীরের নির্জন নিস্তব্ধ পটভূমিতে বলিষ্ঠ চিত্র গোরার হৃদয়ের গোপন নিভৃত রূপকে উন্মোচিত করেছেন। গোরার চিত্তে যে নারী প্রেমের কোন স্থান ছিল না, আজ সেই নারী ও প্রকৃতি এক হয়ে গোরার হৃদয়-সমুদ্র মন্থন করতে লাগল। গোরা সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসীর জীবনের ব্রত গ্রহনে সংকল্প করেছে। কিন্তু যে জীবন সে মনে কল্পনা করেছে, সেই জীবনকে সে ততখানি গ্রহণ করতে পারেনি। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে প্রেমের মিলনে গোরা চরিত্র রবীন্দ্র-উপন্যাসে এক অসাধারণ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
      ‘গোরা’ উপন্যাসে সমস্ত নারী চরিত্র বিশ্লেষণ করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না তারা সকলেই কমবেশি আধুনিক যুগের সময়ের প্রতিনিধি। সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে অস্বীকার করে  চিরায়ত মাতৃশৌর্যের অহংকার শৈল্পিক নৈপুণ্যে গড়া আনন্দময়ী ঔপন্যাসিকের এক অনবদ্য সৃষ্টি। ‘গোরা’ উপন্যাসের যত্রতত্র আনন্দময়ীর আধুনিক মনন, পুরনো সংস্কার বর্জন সর্বপরি যুগের প্রয়োজন সময়ে দাবি মেনে নেওয়ায় যে দীপ্ত প্রত্যয় তা রবীন্দ্রনাথের পরিবর্তিত মনোনয়নের বিবর্তিত নারীর এক বলিষ্ট কন্ঠ। সুচরিতাকেও  ঔপন্যাসিক বের করে আনেন বিদ্যামান সমাজের বিভিন্ন অপসংস্কার থেকে। ব্রাক্ষ পরিবারে বেড়ে ওঠা সুচরিতা গোরার মধ্যে হিন্দুত্বের যে শক্ত বাঁধন প্রত্যক্ষ করে সেটা সাময়িকভাবে তাকে আঘাত করলে ধর্মীয় গোঁড়ামির ভেতরে প্রচ্ছন্ন থাকা হিন্দুতে গোরার গভীর দেশপ্রেম তাকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। গোরা ভেতরে অদম্য শক্তি আর বাইরে তেজ ও জেদ মিশ্রিত যৌত্তিক তর্ক প্রবলভাবে সুচরিতাকে আকর্ষণ করে।  গোরাকে চিনতে পারার মধ্যেই সুচরিতার স্রষ্টা তার চরিত্রের মাহাত্ম্য ফুটিয়ে তোলা।
    ‘গোরা’ উপন্যাসের বিশিষ্ট চরিত্র ললিতা। শক্ত ধাঁচের, বিদ্রোহী চেতনায় তৈরি হওয়া এক বিপ্লবী নারী। সুচরিতার যুক্তি-নিষ্ঠ ভাবনা, বস্তু নির্ভর বিপরীতে ললিতা এক ঝোড়ো হাওয়া। তাই তো সে গোরার তুলনায় অপেক্ষাকৃত নমনীয়, উদারচিত্ত, নিরীহ, নির্বিরোধী  বিনয়কেই তার হৃদয়ের অর্ঘ্য নিবেদন করে বসে। গতানুগতিক সামাজিক বলয়ে এমন জেদী ও তেজোদীপ্ত নারী চরিত্র ঔপন্যাসিকের দুর্জয় সাহসের পরিচয়।  গোড়ার অপ্রতিরোধ্য গোড়ামির বিপক্ষে ললিতার নবচিন্তার অজেয় মনোবল উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য দীপ্তি। এছাড়াও আরও অন্যান্য চরিত্র পাওয়া যায় ‘গোরা’ উপন্যাসে থেকে,যেমন- গোরার পিতা  কৃষ্ণদয়াল, পরেশবাবু, বিনয়, পরেশবাবু স্ত্রী বড়দা সুন্দরী ও তার তিন কন্যা ইত্যাদি।

গোরা উপন‍্যাসের বিশ্লেষণ : 
‘গোরা’ উপন্যাসটি হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশাত্মবোধ উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের পরে বাঙালি পাঠকমহলে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ‘গোরা’ উপন্যাসটি।

‘গোরা’ সম্পর্কে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মন্তব্যটি হল –
“…এত সুন্দর সামাজিক উপন্যাস কদাচিৎ নয়ন গোচর হয়। ব্রাহ্মসমাজের সৌন্দর্য ও কদর্যতা একসঙ্গে আর কোনো উপন্যাসে দেখি নাই। জ্ঞান ও প্রেম, যুক্তি ও অনুভূতি, সহিষ্ণুতা ও বিদ্রোহ ,এ অপূর্ব উপন্যাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় জ্বলিয়া উঠিতেছে।…ইহা শুধু উপন্যাস নহে। ইহা ধর্ম গ্রন্থ। … এ উপন্যাস বাঙ্গালা সাহিত্যের গৌরব…”।

উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হিসেবে যে সময়কাল ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গোরার জন্ম সময়টি ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ। গোরার জন্মের মধ্যে ভারতবর্ষে প্রকৃত স্বরূপ সন্ধানের প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথকে ব্রতি হতে দেখা যায়। ব্যক্তি জীবনে ধারা এবং দেশে চিরন্তন সভ্যতার ধারার সংযোগসাধনের মাধ্যমে মূল সত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে উপনীত হওয়ার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে উপন্যাসটিতে।

শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাঁর ‘রবীন্দ্র- সৃষ্টি-সমীক্ষা“য় এই উপন্যাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাকালে মন্তব্য করেছেন-
“গোরা জাতীয় জীবনের সেই সন্ধিক্ষণের প্রতিনিধি, যখন যুবশক্তি রাজনৈতিক জাগরণের অপেক্ষা ধর্ম সংস্কারের মধ্যেই দেশের মুক্তির সূত্র খুঁজিয়াছে।মনে হয়, তাহার মানসদিগন্ত বঙ্কিমচন্দ্র-বিবেকানন্দ প্রভৃতি প্রথম যুগের দেশনেত্রীবৃন্দের ভাবাদর্শ সীমিত। গোরার মধ্যে যে স্বদেশপ্রেম দেশের প্রাচীন সামাজিক প্রথা ও শাস্ত্র নির্দিষ্ট রীতি-নীতির প্রতি পাশ্চাত্য দীক্ষিত সংশয়বাদীদের নির্বিচার শ্রদ্ধার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় একান্তভাবে ও দুর্জয় ইচ্ছা শক্তির সহিত নিয়োজিত, পরবর্তী উপন্যাস ‘ঘরে-বাইরে’তে তাহারই রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা মোহের দ্বারা বিকৃত হইয়া শাশ্বত ধর্মনীতিকে কলুষিত স্বজাত্যবোধের নিকট অবহেলায় বিসর্জন দিয়াছে”।

ভারতবর্ষের উনিশ শতকের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা দেয়, ভারতবর্ষে এমন একটা সময় এসেছিল যখন ‘হিন্দুত্ব’ ও ‘ভারতীয়ত্ব’কে একে অপরের পরিপূরক হিসাবে দেখা যেত।

‘গোরা’ উপন্যাস সম্পর্কে সুকুমার সেনের মন্তব্য সম্পূর্ণ ও সংযত –
“গোরায় ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের, সমাজের সঙ্গে ধর্মের এবং ধর্মের সঙ্গে সত্যের বিরোধ ও সমন্বয়ের বিরাট চিত্র উদঘাটিত হইয়াছে”।
অন্যদিকে ভূদেব চৌধুরী ‘গোরা’র আলোচনা কালে খুঁজেছেন সমকালীন ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থের সমমনোভাব –
” ‘খেয়া’তেই কবি বুঝিয়েছিলেন- মানব ধর্মের মুক্তি, মানব আত্মার সমৃদ্ধিতে, দেশ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সর্বজনীন মানব প্রেমের শক্তিতে। এই সত্য পথকে বাঙলার তথা ভারতের প্রথম জাতীয় সংগ্রামের ভিত্তিভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করে ‘গোরা’র প্লট পরিকল্পনা করা হল”।


“গোরা” সম্পূর্ণভাবে একটি মানবিক পৃথিবী রচনার কথাই তুলে ধরেছে পাঠকের সামনে। উপন্যাসটির ভেতরের দিকের রয়েছে একটি সভ্যতার কথা। সেই সভ্যতার বস্তুগত ও ভাবগত উত্তরণের কথা। এ কারণেই উপন্যাসটিকে অনেকের কাছে মহাকাব্য বলে মনে হয়েছে।

         বঙ্কিমের দ্বারা বাংলা উপন্যাসে যে পথটি নির্দেশ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম তাকে যথাযথভাবে আধুনিক পদবাচ্য করে তার ভবিষ্যতের গন্তব্যটি চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন। তৎকালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনাচারণ, সৃষ্টিশীল দ্যোতানা এবং চিন্তাশীল ভাবনায় যা স্পষ্ট হয়ে আছে। ব্রাক্ষ ধর্মের মুক্ত সংস্কৃতি, ধর্মীয় অনুভবের সঙ্গে দেশ মাতৃকার নিবিড় বন্ধন সর্বোপরি দেশ-কালের সীমানায় নতুন ও পুরাকালের এক অপূর্ব অভিযোজন ঘটেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘গোরা’ উপন্যাসে। গোরা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হল গোরা। হিন্দুত্বের কঠোর অনুশাসনের পাশাপাশি ব্রাহ্মণ ধর্মের রক্ষণশীলতা এমনকি সীমাবদ্ধতাও নানাভাবে প্রকাশ পায় গোরার বক্তব্যে। মূল চরিত্র গোরাকে যেমন হিন্দুত্বের প্রতি হিসাবে নির্ণয় করেছেন তেমনি একই সঙ্গে আনন্দময়ী, সুচরিতা, ললিতা এবং বিনয়ের মতো আধুনিক চেতনা সম্পন্ন ব্যক্তিও ঔপন্যাসিকের সৃজনসৌধে উপন্যাসের গতি নির্ণয়ের নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। সামাজিক বলয়ের দুই বিপরীত ধারায় পুরানো হিন্দুধর্ম ও আধুনিক ব্রাহ্ম পাশ্চাত্য মননের হরেক রকম যুক্তি তর্কের অবতারণা ঘটে বৃহৎ এই উপন্যাসের সর্বাংশ জুড়ে। গোরা তার পরিচয় জানার আগের মুহূর্ত অবধি দুর্ভেদ ব্রাহ্মন্য সংস্কৃতির আবরণ থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। গোরা ব্রাহ্মণ্যবাদের ঐতিহ্য রক্ষায় শুধু লড়াই করেই গেলেন না নিজেকে সেই দূর্ভেদ্য সংস্কৃতির বলয় থেকে মুক্ত করতেও ব্যর্থ হলে না যতক্ষণ না জানতে পারলেন তার আসল পরিচয়। রক্ষণশীল সমাজের জোরালো প্রতিনিধি গোরাকে এক সময় জেলেও যেতে হয়। ‘গোরা’ উপন্যাসের  সর্বাংশ জুড়ে আনন্দময়ীর যে আধুনিক মনন বৃহদায়তন এই ঘটনা স্রোতের গোরার হিন্দুত্ববাদের জোরালো প্রতিনিধি হয়ে ওঠা যেমন বিস্ময়ের একইভাবে অনভিপ্রেতও। গোরার মত সমাজ‌-রাষ্ট্রের পটে মানবিক সমস্যামূলক ও মননশীল চিন্তা-বিতর্কপূর্ন উপন্যাসে নিসর্গ-চিত্র তথা চিত্রল পরিবেশের বর্ণনা হয়তো খুভ বেশির প্রত্যাশিত নয়। তবু এরই মধ্যে নিসর্গাশ্রিত পরিবেশ-বিন্যাসের যে দৃষ্টান্তগুলো রেখেছেন, তা তাঁর কবি মনের পরিচায়ক।