কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : শিল্পব্যক্তিত্ব ও সীমাবদ্ধতা
বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের পূর্বে দুটি বড় ব্যক্তিত্ব বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ। উপন্যাস ও সৃজনমূলক প্রবন্ধ – কথাসাহিত্যের এই দুই প্রধান বিভাগের প্রকৃত উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে। এবং বিভাগদুটিকে নতুন ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ দান করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের রচনাকে সামনে রেখেই শরৎচন্দ্র যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং উভয়ের কাছ থেকে তাঁর সাহিত্যিক ঋণ স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের প্রভাব তাঁর উপর থাকলেও শরৎচন্দ্র বাংলা উপন্যাসকে একটি বিশেষ পরিধির মধ্যে নিয়ে গিয়ে তাকে এক নতুন জীবনবোধে উদ্দীপ্ত করেছেন এবং সবচেয়ে বড়ো কথা যে তাঁর প্রদর্শিত পথেই ভবিষ্যৎ বাংলা উপন্যাসের অগ্রগতি সূচিত হয়েছে।
শরৎচন্দ্র একদিকে আমাদের পারিবারিক জীবনের চিরন্তন ঘাত প্রতিঘাতকে সাহিত্যে স্থান দিয়ে পুরানো ধারা অব্যাহত রেখেছেন অন্যদিকে বাংলা উপন্যাসে নতুনভাবের উত্তেজনায় নবজীবনের সঞ্চার করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবর্তিত বাস্তবতার ধারা অনুসরণ করলেও তাঁর মৌলিকত্ব নিহিত আছে সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শক্তিগুলিকে সমর্থনের মধ্য দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই শরৎচন্দ্র সম্পর্কে বলেছেন –
“শরৎচন্দ্র সম্পূর্ণভাবেই ছিলেন নিজের দেশের ও কালের। এটা সহজ কথা নয়।”
দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় – এ সময়কার সমাজ জীবনের আলোড়ন সকলেরই পরিচিত। তখন পশ্চিমি জীবনযাত্রা ও পশ্চিমিয়ানার প্রতি বিরূপ মনোভাবই দেশের সাধারণ মানুষকে দেশের প্রতি অধিকতর সচেতন করে তুলেছিল। আবার সেইসময় রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর অনুগামীরা পুরানো সামাজিক সংস্কার ও রীতিনীতির প্রতি স্পর্শকাতরতা না দেখিয়ে নতুন যুগোপযোগী ও ব্যক্তিচেতনা প্রকাশক সমাজচেতনাকে তুলে ধরতে এগিয়ে এলেন। অপরদিকে রক্ষণশীল সম্প্রদায় দাঁড়ালেন এই আধুনিকতার বিরুদ্ধে ; তাদের স্পর্শকাতরতা হিন্দু সমাজের প্রাচীন ধ্যানধারণা ও পুরানো জীবনধারার প্রতি। সমাজ সম্পর্কে এ জাতীয় সচেতনতার যুগসন্ধিতে শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমগ্র ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যসৃষ্টির কালপর্বকে বিশ্লেষণ করলে চোখে পড়ে মোটামুটি তিনটি কালপর্যায় –
১. উনিশ শতকের অন্তিম পর্ব
২. বিশ শতকের প্রথম দুই দশক
৩. প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালপর্ব
আবার, তাঁর উপন্যাসগুলিকে সময়পর্ব হিসাবে বিচার করে মোটামুটি চারটি পর্যায় পাই –
১. প্রথম পর্যায় – সূচনা পর্ব (১৯১৪)
শুভদা, বড়দিদি, বিরাজ বৌ
২. দ্বিতীয় পর্যায় – প্রস্তুতি পর্ব (১৯১৪ – ১৯১৬)
পরিণীতা, পন্ডিতমশাই, পল্লীসমাজ, চন্দ্রনাথ, বৈকুন্ঠের উকিল, অরক্ষণীয়া
৩. তৃতীয় পর্যায় – সৃষ্টির শীর্ষ (১৯১৭ – ১৯২৭)
শ্রীকান্ত(১ম), দেবদাস, নিষ্কৃতি, চরিত্রহীন, স্বামী, শ্রীকান্ত(২য়), দত্তা, বামুনের মেয়ে, গৃহদাহ, দেনাপাওনা, নববিধান, পথের দাবী, শ্রীকান্ত(৩য়)
৪. চতুর্থ পর্যায় – সমাপ্তি পর্ব (১৯৩১ – ১৯৩৫)
শেষ প্রশ্ন, শ্রীকান্ত(৪র্থ), বিপ্রদাস, শেষের পরিচয়(১৯৩৯)
তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির ওপর ভিত্তি করে শিল্পীসত্তার কিছু আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ঠ্য লক্ষ্যণীয় –
● শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে পল্লীজীবন –
হুগলির বিস্তীর্ণ অঞ্চল – দেবানন্দপুর থেকে শুরু করে কৃষ্ণপুর, দিখাড়া, ভাগলপুর, দুরের পান্ডুয়া স্টেশন – জন্মসূত্রে পাওয়া পশ্চিমবঙ্গের এই পল্লীজীবন ও শিথিল পল্লীসমাজকে শরৎচন্দ্র চিনতেন আবাল্য।
পল্লীর নরনারীর সুখ দুঃখ, সাধ আহ্লাদ, সমস্যা সংবেদনশীল কিশোর মনে স্থায়ী ছাপ ফেলেছিল। পরবর্তীকালের পরিণত মনন তাকেই নানা পরিপ্রেক্ষিতে পটে বিচিত্র অভিজ্ঞতার নিরীখে সমাজ সত্য ও সমাজশক্তি হিসাবে পরিচিত করে। প্রথম জীবনের পল্লীজীবন ও পল্লীগৃহের স্নেহ মমতার যে করুণ সুকোমল প্রকাশ তাঁর সাহিত্যের মর্মটি অধিকার করে রেখেছিল বড়দিদি, বিরাজ বৌ, বিন্দুর ছেলে, মেজদিদি, রামের সুমতি প্রভৃতি রচনায়, পরবর্তী গ্রন্থে সমাজের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া, বিভিন্ন চরিত্রের মানুষের মধ্যে সমাজ শাসিত সংকটের কূট সামাজিক ব্যধি ও সংস্কার – তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বারা নিশেষিত হয়ে সংশ্লেষ ও বিশ্লেষের ক্রমে একান্ত সমাজভাবনার দলিলে পর্যবসিত হতে পেরেছিল পল্লীসমাজ, দেবদাস, শেষপ্রশ্ন, পন্ডিতমশাই, চরিত্রহীন ইত্যাদি উপন্যাসে। এই সমাজের সঙ্গে তাঁর পরিচয় যেমন অন্তরঙ্গ ও প্রত্যক্ষ তেমনি এর প্রতি অনুরাগ ও সহানুভূতি ছিল তাঁর রক্তের গভীরে।
‘সমাজধর্মের মূল্য’ প্রবন্ধে তিনি স্বীকার করেছেন –
“যে সমাজ মড়া মরিলে কাঁধ দিতে আসে, আবার শ্রাদ্ধের সময় দলাদলি পাকায়,… উৎসব ব্যসনে যে সাহায্যও করে, বিবাদও করে, যে সহস্র দোষ ত্রুটি সত্ত্বেও পূজনীয় – আমি তাহাকেই সমাজ বলিতেছি।”
শরৎচন্দ্রের সময়ে ইংরেজি শিখে চাকরি পাবার আগ্রহে অধিকাংশ পল্লীগ্রাম দেশবাসী গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে ছুটেছিল, প্রয়োজন অতিরিক্ত শিক্ষিত বেকারের সমস্যা উৎকট রূপ নিয়েছিল, যার অবশ্যাম্ভাবী সামাজিক পরিণামের চিত্র তুলে ধরেছিলেন শরৎচন্দ্র। যেমন অবহেলিত বাংলার গ্রামে গ্রামে বেণী ঘোষালের মতো অশিক্ষিত ক্ষমতখলোলুপ নিষ্কর্মাদের প্রতাপ বৃদ্ধি পেয়েছিল, বিংশ শতকের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের প্রতীক শিক্ষিত শ্রীকান্ত প্রাণধারনের
জন্য বাংলাদেশ ছেড়ে বর্মা গিয়েছিল, গফুরের মতো দরিদ্র কৃষককে জমিদার শিবনাথের অত্যাচারে চাষ ছেড়ে চাকুরির জন্য চটকলে যেতে হয়েছিল আবার রূপহীন বালিকা জ্ঞানদা রক্ষণশীল পল্লীকর্তাদের চক্রান্তে অরক্ষণীয়াই থেকে গেল। এইসবই শরৎচন্দ্র তাঁর সাহিত্যে সুষ্ঠ সাবলীল এবং সার্থকভাবে তুলে ধরেছেন। মানবজীবনের টুকরো টুকরো লঘু অনুভূতি থেকে শুরু করে জীবনের গভীরতম সত্যোপশব্ধি, যা দিয়ে তাঁর জীবনদর্শন রচিত, নরনারীর চিরন্তন হৃদয়দ্বন্দ্ব, সামাজিক জীবনের ঘাত প্রতিঘাত এক কথায় বিচিত্র জীবনের ছবি তিনি মূলত পল্লীজীবন থেকেই সংগ্রহ করেছেন এবং এই ক্ষেত্রকেই তাঁর সাহিত্যের বিষয় করে তোলার মধ্যেই তাঁর গুরুত্ব, কৃতিত্ব এবং মৌলিকতা।
পরবর্তীকালে তারাশঙ্কর – বিভূতিভূষণ – মানিক – এই ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টি ব্যাপকভাবে পল্লীজীবনকে আশ্রয় করেছে। তাসত্ত্বেও শরৎচন্দ্রের সঙ্গে এঁদের মৌলিক পার্থক্য এই যে, এঁরা পল্লীজীবনের এক একটি আঞ্চলিক রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন, অন্যদিকে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে বিশেষ বিশেষ গ্রামের উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও পল্লীজীবনের কোনো আঞ্চলিকরূপ চোখে পড়ে না। পল্লীজীবনের সঙ্গে মিলিয়ে যে সমাজ জীবনের ছবি দেখি শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে তার ভিতর দিয়ে বরং চিরায়ত একটা পল্লীসমাজের পরিচয় পাওয়া যায়।
আর সেই কারণেই সুদূর দক্ষিণ ভারতের প্রথিতযশা সাহিত্যিক পিপাসুরা শরৎচন্দ্রের বই পড়ে মনে করেন যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাদেরই অধিবাসী। তবে, ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য থাকলেও মিল এইখানেই যে পল্লীজীবনের রূপায়ণের ভিতর এদের দার্শনিকসুলভ একটা চেতনা আত্মপ্রকাশ করেছে।
● সমাজবাস্তবতা –
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমাজের প্রত্যক্ষ চিত্র আঁকতে গিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই সমাজে চলে আসা বহু প্রথা, প্রথা সংক্রান্ত বিরোধ, লৌকিক সংস্কারের চিত্র তুলে ধরেছেন। বস্তুত তৎকালীন সামাজিক যতগুলি সংস্কারের দীর্ঘকালের প্রচলিত জননীতির কবলে পড়ে অপব্যাখ্যায় ও অপপ্রয়োগে কুসংস্কারে পরিণত হয়েছে – তাদের প্রায় প্রত্যেকটি অকপটভাবে শরৎচন্দ্র বিশ্লেষণ করেছেন।
‘অরক্ষণীয়া’ উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সোজাসুজি সমাজে প্রচলিত কন্যাদায় সমস্যাটিকে বিষয় করেছেন। এখানে তিনি এক দরিদ্রা অবিবাহিতা কন্যার সংকটকে অবলম্বন করলেও বস্তুত হিন্দু অন্তঃপুরের সর্বপ্রকার দুঃখ, জ্বালাহীনতা, ঘৃণ্যতা ও পঙ্কিলতা এই বিশ্রী প্রথার ফলশ্রুতি প্রকটভাবে উন্মোচিত হয়েছে।
আবার, কৌলিন্য প্রথা ও তার অবক্ষয় এবং জাত্যাভিমানের পরিণতি দেখতে পাই ‘বামুনেরমেয়ে’, ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসে। সেদিনের বড় বামুন ছোট বামুনের ভেদচিন্তাকে শরৎচন্দ্র কখনোই মিলনের পটভূমিতে ব্যবহার করতে পারেননি। কৌলিন্য প্রথার এই জড় দিকটি শরৎমানসকেও আক্রান্ত করেছিল হয়ত কিন্তু সামাজিক এই বাধাকে পার হবার সাহস ফলিত হতে পারেনি তাঁর নিজেরই বিশেষ মানসিকতায়।
‘পন্ডিতমশাই’ উপন্যাসে সমাজচেতনার আরও একটি উজ্জ্বল স্বাক্ষর রয়েছে। তিনি জানতেন পল্লীসমাজের শোচনীয় অভাবাত্মক দিকের শিক্ষার অভাব। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষার আলো না পড়লে সমাজের যা কিছু রুচিভ্রষ্টতা, কুপ্রথা এসবের মানসিকতা দূর হবে না। তাই ‘পন্ডিতমশাই’ উপন্যাসের মাধ্যমে গ্রামোন্নয়নের চেষ্টা করেছেন তিনি। ডেনমার্কের লোকের শিক্ষার যে মূল মন্ত্র ‘each one to teach one’ তার পূর্বাভাস শরৎচন্দ্র দিয়েছেন বৃন্দাবনের পাঠশালার মধ্য দিয়ে।
● ধর্মচেতনা –
‘দত্তা’য় শরৎচন্দ্র লিখেছেন –
“কলকাতায় কেশব সেনের প্রচন্ড প্রতাপ। বক্তৃতার বড়ো জোর। সে জোর পাড়াগাঁয়ের ছেলে তিনটে হঠাৎ সামলাইতে পারিল না, ভাসিয়া গেল।”
ব্রাহ্মসমাজ সমকালীন বাঙালি মধ্যবিত্তের ওপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল। তবে, শেষের দিকে কেশব সেনের প্রতিপত্তি কমতে থাকলে ব্রাহ্মসমাজ অস্তমিত হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে যে সমাজের অভ্যুত্থান ঘটেছিল শরৎচন্দ্রের লেখায় তার পতনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ‘দত্তা’য় ব্রাহ্ম রাসবিহারীর চরিত্রে কপটতার দিকটা শরৎচন্দ্র ফুটিয়ে তুলে ব্রাহ্ম পরিবারে ‘সত্য’, ‘সুনীতি’, ‘সুরুচি’ শব্দগুলিকে তিনি যেন ব্যঙ্গ করেছেন। ব্রাহ্ম ও ব্রাহ্মণদের বিরোধের কথাও আমরা তাঁর উপন্যাসে পাই।
শরৎচন্দ্র বরাবরই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের বিরোধী, তিনি সত্য শিব ও সুন্দরের উপাসক ছিলেন। সমাজের ধর্মের সঙ্গে সংস্কারের সম্পর্ক কতটা অঙ্গাঙ্গী তা শরৎচন্দ্র উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে রামবাবুর চরিত্র এত নিখুঁতভাবে অঙ্কন করতে পেরেছিলেন। উপন্যাসে অচলার মধ্যে ধর্ম সংস্কারের দিকটা প্রকাশ করে মৃণালকে তিনি আচার নিষ্ঠ হিন্দু মহিলারূপে অচলার বিপরীতে স্থাপন করেছিলেন – ধার্মিক হৃদয়বোধের ঐশ্বর্য তুলে ধরার জন্য। বঙ্কিমচন্দ্র ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে শৈবালিনীকে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করালেও শরৎচন্দ্র মহিমের ক্ষমাসুন্দর উদারতার ওপর অচলার ভবিষ্যত ছেড়ে দিয়েছেন।
● স্বদেশচেতনা ও রাজনৈতিক ভাবনা –
অন্যায় অত্যাচার, দারিদ্র্য, উপেক্ষা, কুসংস্কার রোগজর্জর সম্বলিত পল্লীজীবনের ধ্যানধারণা শরৎচন্দ্রের পরিবর্তিত হতে থাকে ব্রহ্মদেশে পদার্পণ করে।
তাঁর নিজের বক্তব্য :
“ইহাদের কাছে আমি প্রথম শিখিয়াছি যে, ছোট জাত বলিয়া ঘৃণা করিয়া দূরে রাখার বদ অভ্যাসটা পরিত্যাগ করা মোটেই শক্ত কাজ নয়।”
রাজনৈতিক দিক থেকে সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পরাধীন দেশগুলোর মুক্তিকামী মানুষের বিপ্লবী কর্মতৎপরতার একটি প্রধান ঘাঁটি ছিল তখন রেঙ্গুন শহর। কাজেই প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটতে থাকে। ১৯১৭ খ্রি: লেনিনের নেতৃত্বে প্রথম সমাজ তান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিষ্ঠা এবং ১৯১৭৮ খ্রি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলে পৃথিবীর মানচিত্রের অনেক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে আমাদের দেশেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন শুরু হয়। এইসময় থেকেই শরৎচন্দ্রের ব্যক্তিগত ও সাহিত্যজীবনে ও মননেও রাজনৈতিক কর্মজ্ঞানের প্রয়াসের পরিপূর্ণ সূচনা পরিলক্ষিত হয়।
‘পথের দাবী(১৯২৬) উপন্যাসে সুস্পষ্টরূপে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি শরৎচন্দ্রের দরদ ও সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। সব্যসাচী চরিত্রটি অঙ্কন করেছিলেন নেতাজী, রাসবিহারী বসু সহ বিভিন্ন সশস্ত্র বিপ্লবীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যকে একত্রীভূত করে। শরৎচন্দ্র ও সব্যসাচী বুঝেছিলেন – তৎকালীন সমাজের অগ্রগামী শক্তি হল শ্রমিক শ্রেণী, আর কৃষক তার সহযোগী শক্তি। শ্রমিকের নেতৃত্বেই স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিপ্লব সার্থক হবে এবং এই বিপ্লব শান্তিপূর্ণ নয়।
‘পথের দাবী’ উপন্যাসে সংগঠনের সভ্যদের প্রতি সব্যসাচীর নির্দেশ হল –
“মানুষের চলার পথ মানুষ কোনোদিনই নিরুপদ্রবে ছেড়ে দেয় না।”
ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্দেশ্যে এটাই ছিল শরৎচন্দ্রের বক্তব্য।
বলা বাহুল্য, স্বাধীনতা আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্রই প্রথম তীব্রভাবে উত্থাপন করেন। ‘পথের দাবী’ প্রকাশের কিছুদিন পর অপর একটি রাজনৈতিক উপন্যাস ‘জাগরণ’ লেখেন কিন্তু তা সমাপ্ত হবার আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়।
● পুরাণচেতনা –
শরৎচন্দ্রের সৃষ্ট সব ঘটনা ও চরিত্র বাস্তব মানুষের প্রত্যক্ষ জীবন থেকে উঠে আসা – এই সংস্কার শরৎ সাহিত্যের সহৃদয় পাঠক ও সমালোচকদের ভুল পথে চালিত করেছে।
শরৎচন্দ্রের মানসলোকে দীপ্যমান ছিল কয়েকটি পৌরাণিক ভাবনা – অপার্থিব প্রেম, অপার্থিব স্নেহ, অপার্থিব অনাসক্তির প্রতীক কয়েকটি বিগ্রহ : মহাদেব, অন্নপূর্ণা, উমা, যশোদা – গোপাল, কলঙ্কিনী রাধা। মহাকাব্য, পুরাণ, শাক্ত সাহিত্য, বৈষ্ণব সাহিত্য ও ভারত দর্শন থেকে আহুত এই বিগ্রহগুলি তাঁর মনোলোকে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ ও সিদ্ধান্তের অনন্যতা বৈপরীত্য ও বিরোধ তাঁর কল্পনাকে আচ্ছন্ন করেননি। এই বিগ্রহগুলিতে তিনি প্রাণসঞ্চার করেছেন শরীরের আধারে, যেমন অন্নপূর্ণার ছবি এঁকেছেন অন্নদাদির চরিত্রে, কলঙ্কিনী রাধার শ্রীকান্তের রাজলক্ষী ও চরিত্রহীন উপন্যাসের কিরণময়ী, সাবিত্রী চরিত্রের মধ্যে। আবার, অলৌকিক ও লৌকিক সত্তার সম্বন্বয়ে গঠিত মানব মানবীকে তিনি সংস্থাপিত করেছেন দুঃখ দৈন্য কুশ্রীতা হীনতা অনুশাসন লাঞ্ছিত সমকালীন বাস্তব সমাজের পটভূমিতে।
● সাংকেতিকতা –
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে কিছু সংকেতবহ ছবি আছে যেমন – নিঃসঙ্গ নিশ্চলএকটি গাছ। দেবদাস শেষ আশ্রয় পেয়েছে জমিদার ভুবন চৌধুরীর বাড়ির বাইরে অশ্বত্থ গাছের নীচে। অস্পৃশ্য গফুর জোলার জীর্ণ বাড়ির ভাঙা দেয়ালের গা ঘেঁষে একটা পুরানো বাবলা গাছ, অগ্নিস্রাবী বৈশাখে নিষ্পত্র ; তার ডালে বাঁধা একটা পুরানো অবলা জীব, পরম স্নেহে গফুর তার নাম রেখেছে মহেশ। আবার রাজলক্ষ্মীর আশ্রয় ছেড়ে কমললতার আশ্রয়ের বন্ধন কাটিয়ে স্টেশনের পথে ক্লান্ত সায়াহ্নে শ্রীকান্ত এসে দাঁড়িয়েছে একটি তেঁতুল গাছের ছায়ায় – গাছের গুঁড়ি পাহাড়ের মতো, মাথা ঠেকেছে আকাশে ; এ গাছ তার শৈশব কৈশোরের প্রতিবেশী, বন্ধু, আত্মীয়। এই গাছ এক অর্থে বোধিবৃক্ষ, আর এক অর্থে শূন্যতার প্রতীক। শরৎ সাহিত্যে এই ছবিতে অভিক্ষিপ্ত হয়েছে মানবিক অনুভূতি, নিশ্চল স্থৈর্যের সঙ্গে মিশেছে অনুচ্চারিত বেদনা, নিবৃত্তির সঙ্গে মিশেছে রিক্ত নিঃসঙ্গতা। এই বৃক্ষ দ্বিধাদীর্ণ শরৎ মানসেরই প্রতিবিম্ব। এই দ্বিধার উৎস এক অর্থে হৃদয় ও বুদ্ধির দ্বন্দ্ব অন্য অর্থে চৈতন্য ও জড়তার দ্বন্দ্ব।
ব্যক্তিজীবনের চরমলক্ষ্য কি – আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি না প্রবৃত্তিপূর্ণ আস্বাদন ? প্রেমের পূর্ণতা কি – বিরহে না মিলনে ? অচলা ও মৃণাল, কিরণময়ী ও অন্নদাদিদি, সুমিত্রা ও ভারতী – এইসব চরিত্রের মধ্যে শরৎচন্দ্র দুটি বিপরীত মুখ্যধারা রূপায়িত করেছেন। কিন্তু এই সম্বন্বয়ের কোনো স্পষ্ট চেহারা ফুটে ওঠেনি। নিশ্চল নিঃসঙ্গ বৃক্ষ সংশয় ও নিভৃত বেদনার সাক্ষী ও আধার।
◆ সীমাবদ্ধতা –
শরৎসাহিত্য জীবনভিত্তিক ; তাঁর সৃষ্ট চরিত্র ও ঘটনাবলী জীবন্ত ; সমকালীন যুগের সঙ্গে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা তাঁর সাহিত্যে বিধৃত, গভীর জীবনবোধ থেকে উৎসারিত।
কিন্তু শরৎসাহিত্যের আলোচনায় যে দুটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তার প্রথমটি করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর –
“তুমি উপস্থিত কালের কাছ থেকে দাম আদায় করে খুশি থাকতে পারো – কিন্তু সকল কালের জন্য কী রেখে যাবে ?”
শরৎ সাহিত্যে জনপ্রিয়তা এখনও অসামান্য কিন্তু তা কখনোই শিল্প সাহিত্যের পরিচায়ক নয়। যে সব সমস্যা ও প্রশ্ন শরৎ মানসকে তীব্রভাবে আলোড়িত করেছিল – জাতিবৈষম্য, বর্ণবিভেদ, বিধবা ও পতিতা নারীর লাঞ্ছনা, অর্থনৈতিক অসাম্য পরাধীনতার গ্লানি – পরিবর্তিত সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিতে সেইসব সমস্যার তীক্ষ্ণতা ক্রমশই হ্রাস পেয়েছে। যে গ্রামীণ জীবনধারার চিত্র শরৎচন্দ্র আশ্চর্য দক্ষতায় এঁকেছেন তার চেহারা দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। কাজেই এই প্রশ্ন আসতেই পারে শরৎ রচনা কি তাহলে সমকালীন পরিপার্শ্বের দ্বারা সীমায়িত, পরবর্তী যুগের পাঠক ও সমালোচকের কাছে শরৎসাহিত্যের মূল্য কি ঐতিহাসিক ?
দ্বিতীয় প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিলেন কল্লোল গোষ্ঠীর এক তরুণ কথাশিল্পী :
“কলকাতার কোনো মেসে সাবিত্রীর মতো ঝি যদি থাকতো তবে আমরা সবাই বাড়ি ভুলে মেসে থাকতুম।”
মন্তব্যটি তারুণ্যের প্রগলভতার দৃষ্টান্ত হলেও অপ্রাসঙ্গিক নয়। আবার সপত্নীপুত্রের প্রতি বিমাতার, দেবরের প্রতি ভ্রাতৃজায়ার অকৃত্রিম স্নেহ কি বাস্তব ও মনোবিজ্ঞান সম্মত ?
‘বিন্দুর ছেলে’ গল্পে যাদব মুখুজ্জ্যে জমিদারী সেরেস্তার নায়েব ছিলেন ; বিন্দুর দশ হাজার কাকা সুদে খাটিয়ে দ্বিগুণ করেছেন অথচ জাগতিক ব্যাপারে উদাসীন। এলোকেশী খুবই বাস্তব চরিত্র কিন্তু অন্নপূর্ণা ও বিন্দুর মধ্যে হৃদয়ের যে আত্যন্তিক সম্পর্ক তা কি বাস্তব ?
এছাড়াও দেখি শরৎচন্দ্রের রাজনৈতিক ভাবনা পথচারিতার মধ্যেই কেন্দ্রায়িত, পরিণতির পরিচায়ক হতে পারেনি। আবার দেখা যায় শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে জমিদারতন্ত্র নয় জমিদারি অপশাসনের বিরুদ্ধেই তাঁর সংগ্রামী চেতনা সক্রিয়।
সামগ্রিক আলোচনার নিরীখে শরৎচন্দ্রের মধ্যে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও বলা যায়, ভবিষ্যৎ বাংলা উপন্যাসের গতি প্রকৃতি শরৎচন্দ্রের সাহিত্যের দৃষ্টান্তে অনেকখানি অনুপ্রাণিত হয়েছে। শরৎচন্দ্রের সৃষ্টি প্রেরণার মধ্যে যে আবেগধর্ম এবং বাস্তবজীবনের দীনতা, হতাশা ও স্খলনপতনের মধ্যেও যে আদর্শ উপলব্ধির চেতনা পরিলক্ষিত হয় – তা মুখ্যত বাঙালির সহজাত স্বাভাবিক প্রবণতা। শরৎচন্দ্র থেকে নবীন গোষ্ঠী দেশ কালের বিচিত্র অভিঘাতে অনেকখানি সরে এসে স্বতন্ত্রতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সেই সৃষ্টির বৈচিত্র্য শস্য সম্ভারের দু একটি বীজ হয়ত শরৎচন্দ্র সংগ্রহ করে রেখে গিয়েছিলেন ভাবী দিনের জন্য। হয়ত সেই বীজই অঙ্কুরিত হয়েছিল উত্তরকালের অনুকূল পরিবেশে।
এই প্রসঙ্গে কাজী আব্দুল ওদুদ বলেছেন –
“যাকে সাহিত্যে বাস্তববাদ বা realism বলা হয় তা তার বিভীষিকা আর আকর্ষণ দুই ই নিয়ে বাংলা সাহিত্যে লক্ষণীয় হয়ে উঠল শরৎচন্দ্রের আবির্ভাবের অল্পক্ষণ পরেই।”