বিষয় : বিশ্বায়ন ও ছোটগল্প
কলমে : অনন্যা সাহা, বি.এ (বাংলা), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
অল্প পরিসরে লিখিত ব্যাঞ্জনাময় ছোটগল্পের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের বিষয় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। সাহিত্য যেহেতু সমাজেরই দর্পন সেই কারণে সমাজের অসংগতি থেকে হিতকর বিষয় এ সমস্তই সাহিত্য জগতের প্রধান অংশ হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত বাংলা সাহিত্যেও এর অন্যথা দেখা যায়না। সমাজের খুঁটিনাটি সমস্ত কিছুই আমাদের বাংলা সাহিত্যের অঙ্গবিশেষ। সাহিত্যিক মাধ্যমের অন্যতম একটি ধারা হলো ছোটগল্প। এই ছোটগল্পকে ভিত্তিমূল বানিয়ে সময়ের প্রেক্ষিতে অনেক সাহিত্যিকবর্গ নানা প্রকারের বিষয়কে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
তথাকথিত ভাবে সাম্প্রতিক উনিশ এবং বিশ শতকের সময়ে যখন জনকল্যাণের স্বার্থে দেশের অর্থনীতিকে অবাধ করে দেওয়া হয় সেই সময় আমাদের দেশের সাথে বিদেশের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। যে যোগসূত্রের জন্য বিশ্বায়নের আরম্ভন সূচিত হয়। বিশ্বের নানান স্থানের সাথে দেশের বাজারের আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে উদারনীতি গ্রহণ করা হয় যার ফলে দেশে বিভিন্ন অত্যাধুনিক জিনিসের অবাধ প্রবেশ স্বীকৃত হয়। মানুষ ধীরে ধীরে এই অত্যাধুনিক জিনিসপত্রের সংস্পর্শে আসে এবং তাদের মনোভাবও সময়ের সাথে বদলাতে থাকে। তারা তাদের যাপনের সাথে প্রযুক্তিকে একাত্ম করে উন্নততর হয়ে ওঠার যাত্রায় সম্মিলিত হয়।
তবে এ সবের মাঝে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মানুষেরা দলিত হতে থাকে। উচ্চবিত্ত মানুষেরা যে ভোগের সামগ্রীর ব্যবহার করতে শুরু করে,সেই ভোগের সামগ্রীগুলির প্রতি লালসার চোটে এই নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষেরাও ভোগ্যপন্য উপভোগের পন্থা খুঁজতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্থের অভাবে তাদের হার মানতে হয়। মনের মধ্যে ভোগ্যপন্য লাভের বাসনা তাদের অতৃপ্তই রয়ে যায়। প্রযুক্তির ফলে হেরে যাওয়া এমনি এক যুবকের গল্প, গল্পকার স্বপ্নময় চক্রবর্তী লিখে যান। যেখানে বিশ্বায়নের এক অভিশপ্ত কাহিনী বিবৃত হয়েছে।
◆ ছোটগল্পের পরিচিতি :
আমাদের আলোচ্য ছোটগল্পটির নাম স্বপ্নময় চক্রবর্তীর লেখা “ঝড়ে কাক মরে”। গল্পটি প্রকাশিত হয় রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে ১৯৮৯ সালে। গল্পের নামটি নিতান্তই প্রতিকী। উক্ত নামকরণের মাধ্যমে লেখক বুঝিয়েই দিয়েছেন গল্প মধ্যে এমন এক আখ্যান বর্ণিত হয়েছে যেখানে আছে হটাৎ দুর্যোগের ফলে সাধারণের পতন। ঝড় বলতে এখানে “টেকনোলজির ঝড় “ – এর কথা বলা হয়েছে যে টেকনোলজির ঝড় সাধারণ মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে অকল্পনীয় দুরাশা। এই ঝড় হলো সাম্প্রতিক বিশ্বায়নের ফলস্বরূপ। বিশ্বায়নের ফলে মানুষের জীবনে নানান ধরণের বিকল্পের আগমন ঘটে যে বিকল্প গুলিকে একের পর এক খরিদ করতে করতে মানুষ হয়ে ওঠে ভোগবাদী। এবং মানুষের ভোগবাদী হওয়ার সুবাদে সমাজও ভীষণ ভোগপ্রবণ হয়ে হয়ে পরে। ভোগের বৃদ্ধি বিলাসের বাহুল্যতার জন্য দায়ী। অন্যদিকে বিলাস মানুষের পতনের কারণ। গল্পটি লেখক আসন্ন পতনের দৃশ্যকে অনুমান করেই রচনা করেন। কিছু মূলধন যুক্ত মানুষ এই প্রযুক্তির ঝড়ে সুরক্ষিত থাকলেও সাধারণ মানুষ এই ঝড়ের তোরে বয়ে যায়। ভোগবিলাসের বাহুল্যতা মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে বহুল পরিমানে সুগম করলেও এর ফল ভয়ঙ্কর, মানুষের সাধারণ নৈতিকতা বোধ ভোগের আশায় লোপ পায় এবং সমাজের ভিত্তি হতে থাকে
অন্তসারশূন্য।
◆ লেখক পরিচিতি :
স্বপ্নময় চক্রবর্তী মহাশয় এক খ্যাতনামা সাহিত্যিক। কলকাতা নগরীতে তাঁর জন্ম ১৯৫১ সালের ২৪ আগস্ট। নিজের সাহিত্যিক জীবনে তিনি আনন্দ পুরস্কার এবং বঙ্কিম পুরস্কারে ভূষিত হন। মূলত ছোটগল্পের লেখক হিসেবে তথা ছোটগল্পকার হিসেবে তিনি বাংলা সাহিত্য জগতে সুনাম অর্জন করেন। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে তাঁর ছোট গল্পের সম্ভার অনন্য। ছোটগল্প ছাড়া বিভিন্ন নির্বাচিত কলামে লেখালিখির ক্ষেত্রেও তিনি সনামধন্য। বহু উপন্যাস এবং প্রবন্ধও তাঁর রচনার তালিকা থেকে বঞ্চিত হয়নি। অমৃত পত্রিকায় ১৯৭২ সালে তাঁর প্রথম ছোট গল্প ছাপা হয়। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘হলদে গোলাপ‘ উপন্যাসটি আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হয়। এরপরে ২০০৫ সালে ‘অবন্তিনগর‘ উপন্যাসের জন্য তিনি বঙ্কিম পুরস্কার পান। বিশ শতকের সময় পর্বে দাঁড়িয়ে তিনি বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে সচ্চার হয়ে ওঠেন। স্বপ্নময় চক্রবর্তী ছাড়াও আরও অনেক সাহিত্যিক ছিলেন যাঁরা সাহিত্যের মাধ্যমে, বদলে যাওয়া যুগের বিরূপ প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন। দেশের সাহিত্যিক দলের,সাহিত্যের মাধ্যমে এই বিরোধ বিষয়টি আসে সমাজের তথা মানুষের প্রতি তাঁদের দায়িত্ববোধ এবং সচেতনতা থেকে। বলাবাহুল্য এই আলোচনা গুলির মূলে যে বিষয়টি কার্যকরী হয়েছিল তা ছিল আধুনিক যুগের বুকে দাঁড়িয়ে সাহসিকতার সাথে বিশ্বায়নের বিরোধিতা।
◆ ‘ঝড়ে কাক মরে’ ছোটগল্পটির বিষয়বস্তু :
গল্পের শুরুতেই একটি প্রশিক্ষণের দৃশ্য দেখানো হয়েছে যেখানে গল্পের নায়ক একটি কোম্পানিতে জেরক্স মেশিন চালানোর প্রশিক্ষন নিতে আসে। প্রতিযোগিতাপূর্ণ আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে এই যুবক, পেশার খোঁজে অত্যাধুনিক জেরক্স মেশিন নিয়ে ব্যবসা দাঁড় করানোর প্রচেষ্টায় নিযুক্ত হয়। নিজের পরিজন,পরিবার,বন্ধু, প্রতিবেশী সবার থেকে টাকা ধার করে যুবকটি দামী জেরক্স মেশিন ক্রয় করে বৃত্তি স্থাপনে উদ্যোগী হয়ে ওঠে এবং সাফল্যতার আশায় নিমগ্ন হয়। তবে যে সাফল্যতার সে স্বপ্ন দেখেছিল সেই সাফল্যতা, সে শেষ পর্যন্ত পায়না। সময়ের ফেরে তার ভাগ্য অতলে তলিয়ে যায় । গল্পে আমরা দেখি যুবকটির পরিবার সেরকম স্বচ্ছল নয় তারা দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। তাই পরিবারের তথা নিজের কষ্ট ঘোচাতে এই যুবক মেশিন নিয়ে ব্যবসায় নামে। প্রথম মাসে তার তিনশো টাকা উপার্জন হয় এবং সেই উপার্জন ধীরে ধীরে বাড়ার পথে এগিয়ে চলে। যুবকটি এই বাড়তি উপার্জনের আশায় ভরে ওঠে ও আরো মন প্রাণ দিয়ে কাজ করতে থাকে। কিন্তু এই বার-বাড়ন্ত বেশি দিন টেকেনা। তার আধুনিক জেরক্স মেশিনের বদলে অত্যাধুনিক স্পিড কপি মেশিনের আবির্ভাব হয়। যার কার্যক্ষমতার পাশাপাশি দামও অভাবনীয় ভাবে অধিক। একটি জেরক্স মেশিন কিনতেই যে গ্রাজুয়েট বেকার ছেলের অবস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকে তার পক্ষে এই কপি মেশিনকে টেক্কা দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিলোনা। তাই দিনের পর দিন প্রযুক্তির কাছে তাকে নিজের ও তার জেরক্স মেশিনের পরাজয় প্রত্যক্ষ করতে হয়। মানুষের কাছে সুবিধা লাভই হলো সব থেকে প্রয়োজন গ্রাহ্য তাই পুরোনো প্রযুক্তির জেরক্স মেশিন ছেড়ে তারা চলে যায় স্পিড কপির সদর দরজায়। এমন ঘটনার জন্য যুবকটিকে নিজের প্রেম, ভালোবাসা, আবেগ সব ভুলে আবার অভাবের জীবনে ফিরে আসতে হয়। অন্যদিকে মেশিনের সাহায্যে ব্যবসা তৈরির স্বপ্ন তার স্বপ্ন হিসেবেই রয়ে যায়। গল্পের অন্তিম লগ্নে আমরা দেখি নিজের কষ্টের ফলন স্বরূপ মেশিনটিকে ধার মেটানোর জন্য যুবক বিক্রি করে দেয় এবং স্পিড কপি সেন্টারে কর্মচারী হিসেবে যোগদানের ইচ্ছে প্রকাশ করে এবং গরুর গাড়িতে চরে “দুগ্-গা দুগ্-গা” ধ্বনির আবেসে যুবকের দোকানের বেদি শুন্য করে জেরক্স মেশিন চলে যায় অজানার পানে ।
◆ ‘ঝড়ে কাক মরে’ গল্পে লেখকের বক্তব্য :
সারা গল্প জুড়ে লেখক খুবই ভালো ভাবে প্রযুক্তির উন্নয়নের এর অন্ধকারময় দিককে উদ্ঘাটন করেন এবং এর পাশাপাশি গল্পের নায়কের অকাল পতনের কাহিনী আমাদের কাছে প্রযুক্তির এক অনাকাঙ্খিত ভয়ঙ্কর প্রভাবকেই স্পষ্ট করে তোলে। গল্পে উল্লিখিত এক স্থানে “বিজ্ঞানের জয়যাত্রা” এবং “বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ” এই দুই রচনার শিরোনামের অবস্থান দেখা যায়। বলাবাহুল্য উপমার আড়ালে লেখক এই দুই শিরোনামের তাৎপর্যই গল্প মধ্যে পরিস্ফুট করেন। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার বিবরণে লেখক প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির দিকটির ব্যাখ্যা দেন যেখানে জেরক্স মেশিন থেকে প্রিন্টিং মেশিনের জনপ্রিয়তা বাড়ার প্রসঙ্গ দৃষ্টিগোচর হয়। অন্যদিকে বিজ্ঞানের অভিশাপের সাপেক্ষে বেকার গ্রাজুয়েট ছেলেটির দূরাবস্থার ছবি অঙ্কন করেন। প্রযুক্তির জোয়ারে গতি এবং মূলধন যে সবথেকে বড়ো অস্ত্র এর আভাসও লেখক দেন। উচ্চশিক্ষিত যুবকটি শুধু মাত্র মূলধনের অভাবে জোচ্চোর মুকুল সিকদারের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। পুরোনো গতিহীন মেশিন আধুনিক কালের প্রেক্ষিতে নিষ্প্রয়োজনীয় অন্যদিকে গতি সম্পন্ন যন্ত্র সমূহই হলো প্রবল প্রয়োজনের দাবিদার। এই কারণেই যুবকটির দুমিনিটে একটি প্রিন্ট করার মেশিনকে ছেড়ে খদ্দের ছুটে যায় মিনিটে কুড়িটি জেরক্স করা প্রিন্ট মেশিনের কাছে। শেষে যুবকটিকে প্রযুক্তির কাছে এবং মূলধনের কাছে মাথা নোয়াতেই হয়। লেখক এই ভাবেই উক্ত রচনার মাধ্যমে বিশ্বায়নের এক করুণ প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেন।
◆ গল্পটির প্রতি ভালোলাগার উদ্রেকের কারণ :
উনিশ শতকের সময়ে দাঁড়িয়ে বিশ্বায়নের বিরূপ প্রভাব নিয়ে লেখা আলোচ্য ছোটগল্পটি বিশেষ অনন্যতার দাবিদার। ভোগবাদী সমাজের জ্বলন্ত কিছু দৃশ্য আমরা গল্পটির আখ্যান ভাগে প্রত্যক্ষ করি। মানুষ কখনো অল্পেতে খুশি থাকেনা তারা অসীমের পিয়াসী। যে অসীমের সন্ধানে তারা প্রযুক্তির আবিষ্কার করে। তবে অগোচরে এই প্রযুক্তিরও এক কু দিক বর্তমান আছে এবং এই কু দিকের জন্যই অনেক মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পরে। মূলত সচেতনতার উদ্রেক ঘটাতে এই গল্পের যথেষ্ট ভূমিকা বিদ্যমান। যে মানুষেরা বিশ্বায়নের মায়ার দ্বারা প্রভাবিত বিশেষ করে তাদের চক্ষু উন্মোচনের ক্ষেত্রে গল্পটি গুরুত্বপূর্ণ। কাঙ্খিত স্বপ্নকে হারানোর পরে গল্পের নায়ক একা ও শূন্য হয়ে পরে। তার মননে আসে অবিরাম আক্ষেপের ধারা। প্রযুক্তির উন্নয়ন তার আশাকে করে দেয় নিষ্প্রভ। আশার সাথে তার ভরসাও ঠেকে তলানিতে গিয়ে। মূলধনের প্রাধান্য যুক্ত সমাজে তার বিক্রিত মেশিনের সাথে তার ভরসাও বিদায় নেয়। যে ভরসায় ভর করে সে মেশিনটি কিনেছিলো সেই ভরসা হরণ করে প্রযুক্তির ঝড়। প্রযুক্তির মায়াবল অমোঘ। যে মায়া আসলে মানুষেরই তৈরি। এবং দুঃখজনক ভাবে এই তৈরির কবলে মানুষ নিজেই দলিত ও দমিত।
পরিশেষে বলা যায় প্রত্যেক বিষয়েরই ভালো মন্দ দুই দিকই আছে। শুধু মাত্র ভালো দিকটিকে প্রত্যক্ষ করে মন্দ দিককে উপেক্ষা কখনোই যুক্তিগ্রাহ্য নয় লেখক এই বিষয়টিকেই স্পষ্ট করেছেন “ঝড়ে কাক মরে” ছোটগল্পটির মাধ্যমে। “জানো, ঝড় বইছে টেকনোলজির ঝড়” এই উক্তিটির মাধ্যমে আমরা তৎকালীন সময়ের প্রযুক্তির বাহুল্যতার মাত্রাকে আন্দাজ করতে পারি।
এছাড়া “দামের সাথে পারবে যুদ্ধ করে?কদিন পরে আরো ভালো আর আরো দামী কিছু বেরিয়ে যাবে” – এই উক্তিটি মূলধন ছাড়া অভাবি ব্যক্তিসকলের দুস্থ অবস্থার কথাই ফুটিয়ে তুলেছে গল্প মধ্যে। সর্বোপরি বলা চলে সারা গল্প জুরে লেখক কোনোভাবেই প্রযুক্তির প্রতি অসহনীয়তা প্রদর্শন করেননি বরং তিনি গল্পের মাধ্যমে দেখিয়েছেন আশীর্বাদ স্বরূপ বিজ্ঞানের ফলে ঘটিত কিছু অপার্থিব তথা অনাকাঙ্খিত ঘটনাবলি।