রক্তকরবী নাটক আলোচনা

কলমে: অদিতি সিংহ, স্নাতকোত্তর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানেই স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কিছু করে দেখানো। একটা সময়ের ইতিহাসকে ধরে রাখতে সাহিত্য রচনা করা হয়। সেই সব সাহিত্য রচনার একমাত্র দলিল হলো ‘নাটক’। যা সময় ও সমাজের প্রতিচ্ছবিকে ধরে রাখে। সমাজের নিয়ম ভাঙ্গার পালা প্রকাশ পেয়েছে এই নাটকে। যে রাজা কেবল এক খাঁচার ভেতরে আবদ্ধ থাকে, সেই রাজার খাঁচা ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনাই উঠে এসেছে এই নাটকের মধ্যে দিয়ে।

রক্তকরবী’ নাটকের পরিচয় :
       মানুষের অসীম লোভ কীভাবে জীবনের সব সৌন্দর্যকে সময়ের পরিশেষে হার মেনেছে, স্বাভাবিকতাকে প্রতিমুহূর্তে অস্বীকার করে মানুষকে নিছক যন্ত্র ও উৎপাদনের প্রয়োজনীয় বানিয়েছে, প্রয়জনের উপকরণে পরিণত করেছে এবং এর ফলে তার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ কীরূপ ধারণ করেছে, এরই প্রতিফলন ঘটেছে এ নাটকটিতে।
     যক্ষপুরীর রাজার রাজধর্ম প্রজাশোষণ, তার অর্থলোভ দুর্দম। সে লোভের আগুনে পুড়ে মরে সোনার খনির শ্রমিকরা। রাজার চোখে শ্রমিকরা মানুষ নয়, তারা স্বর্ণলাভের যন্ত্রমাত্র; তারা ৪৭ক, ২৬৯ফ মাত্র, তারা যন্ত্রকাঠামোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঙ্গ মাত্র। মানুষ হিসেবে তাদের কোনো দাম নেই।
প্রকাশকাল: ১৩৩০ সনের শিলং-এর শৈলবাসে রচিত হয় এই নাটকটি। তখন এর নামকরণ হয়েছিল ‘যক্ষপুরী’। ১৩৩১ সনের আশ্বিন মাসে ‘প্রবাসীতে’ প্রকাশিত হয় তখন এর নাম ‘রক্তকরবী’ রাখা হয়। 
উৎসর্গ: নেই।
সঙ্গীত: রক্তকরবী’ নাটকে আটটি গান আছে।
তার মধ্যে ছ’টা বিশু গেয়েছে আর দুটো নন্দিনী। বিশুর সবকটি গানই নন্দিনীকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া হয়েছে।
একটি নাটকের ক্ষেত্রে মূল উপাদান হলো সংলাপ ও গান, তার গুরুত্ব অপরিসীম আকার ধারণ করে। যদিও নাটকে সংলাপ প্রধান অবলম্বন; নাট্যধারা নিয়ন্ত্রণের জন্যও গানের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যাই না। প্রকৃতপক্ষে সংগীতের ব্যবহার তখনই সার্থক, যখন সংগীত সংলাপের ভূমিকা গ্রহণ করে। “রক্তকরবী” নাটকে সংগীত দুই সংলাপের মধ্যবর্তী কত না বলা কথা ও অনেক ব্যঞ্জনাকে নাট্যতাৎপর্যে মণ্ডিত করে।
রবীন্দ্রনাটকে সংলাপ ও গানের ব্যবহার বরাবরের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ‘শারদোৎসব’, ‘রাজা’ কিংবা ‘ফাল্গুনী’ প্রধানত সংগীত প্রধান নাটক। ‘মুক্তধারা’তেও সংগীতের প্রয়োগ যথেষ্টই। প্রথম এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ গানটি হল –
‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে…’
নাটকের প্রথম দিকে নন্দিনী – রাজার প্রথম সংলাপগুচ্ছে এই গানটি নেপথ্য থেকে ভেসে এসেছে। গানটি ‘ফসল পেকেছে , কাটতে হবে , তারই ডাক’। সে গানের মধ্যে দিয়ে যক্ষপুরীর আশাহীন অন্ধকারের বিপরীতে মুক্তির আহ্বান শোনা গেছে, প্রেমের আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে। যেখানে ‘রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে।’ –এমনই এক মুক্ত পরিবেশে রাজাকে মাঠে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানায় নন্দিনী।
দৃশ‍্য অঙ্ক:
এই নাটকে একটি মাত্র দৃশ্য অঙ্কিত হয়েছে।

রক্তকরবী নাটকের বিষয়বস্তু :

“এই নাট্য ব্যাপার যে-নগরকে আশ্রয় করিয়া আছে তাহার নাম যক্ষপুরী। এখানকার শ্রমিকদল মাটির তলা হইতে সোনা তুলিবার কাজে নিযুক্ত। এখানকার রাজা একটা অত্যন্ত জটিল আবরণের আড়ালে বাস করে। প্রাসাদের সেই জালের আবরণ এই নাটকের একটিমাত্র দৃশ্য। সেই আবরণের বহির্ভাগে সমস্ত ঘটনা ঘটিতেছে।”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

      রক্তকরবী নাটকে মনুষ্যত্ব, মানবতা এ যন্ত্রবন্ধনে পীড়িত ও অবমানিত হয়েছে। জীবনের প্রকাশ যক্ষপুরীতে নেই। অন্তর্নিহিত জীবনের প্রকাশের সম্পূর্ণরূপ- প্রেম ও সৌন্দর্য, নন্দিনী তার প্রতীক। এ নন্দিনীর আনন্দস্পর্শ যক্ষপুরীর রাজা কোনোদিন পাননি তাঁর লোভের মোহে, সন্ন্যাসীও তাঁর ধর্মসংস্কারের মোহে, মজুররা পায়নি। অত্যাচার ও অবিচারের লোহার শিকলে বাঁধা পড়ে, পন্ডিত পায়নি দাসত্বের মোহে। যক্ষপুরীর লোহার জালের বাইরে প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রতীক নন্দিনী সবাইকে হাতছানি দিয়ে ডাকল; এক মুহূর্তে মুক্ত জীবন মহিমার স্পর্শে সবাই চঞ্চল হয়ে উঠল। রাজা নন্দিনীকে পেতে চাইলেন যেমন করে তিনি সোনা আহরণ করেন, শক্তির বলে কেড়ে নিয়ে। কিন্তু প্রেম ও সৌন্দর্যকে এভাবে লাভ করা যায় না। তাই রাজা নন্দিনীকে পেয়েও পাননি।
        একইভাবে মোড়ল, পন্ডিত, কিশোর, কেনারাম সবাই প্রাণপ্রাচুর্যের মধ্যে বাঁচার জন্য ব্যাকুল হয়ে জালের বাইরের দিকে হাত বাড়াল। কিন্তু নন্দিনী রঞ্জনকে ভালোবাসে তাই তার মধ্যে প্রেম জাগিয়ে তুলেছে। কিন্তু রঞ্জন যন্ত্রের বন্ধনে বাধা। এ যন্ত্র তার প্রেমকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল-এটাই যান্ত্রিকতার ধর্ম এবং কবি তা বিশ্বাস করেন। নন্দিনীর প্রেমাস্পদ যান্ত্রিকতার যুপকাষ্ঠে নিঃশেষিত হলো এবং আবার যেন প্রেমকে ফিরে পাওয়া যায় সে লক্ষ্যে জীবন জয়ী হলো। আর এই দৃষ্টিভঙ্গী রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতায়, গাঁথায়, নাটকে, গল্পে পরিস্ফুট হয়েছে। কবি নাটকটিতে জড় যান্ত্রিকতা ও জীবনধর্মের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য সন্ধান করেছে।

‘রক্তকরবী’ নাটকে চরিত্র পরিচয় :
রক্তকরবী নাটকের মধ্যেই কবি আভাস দিয়েছেন,
“মাটি খুঁড়ে যে পাতালে খনিজ ধন খোঁজা হয় নন্দিনী সেখানকার নয়; মাটির উপরিতলে যেখানে প্রাণের, যেখানে রূপের মৃত্যু, যেখানে প্রেমের লীলা, নন্দিনী সেই সহজ সুখের সেই সহজ সৌন্দর্যের।”

     রবীন্দ্রনাথ যখন ‘রক্তকরবী’ নন্দিনীকে এঁকেছেন, তখন যেন তার চেতন বা অবচেতনে মনের পেট তো লোভ পেয়েছিল কি না সে প্রশ্ন স্বতন্ত্র। যদি বা থেকে থাকে তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী যে এ বাংলার মেয়ে আমাদের একান্ত আপনজন সে বিষয় আমাদের সহজেই মনে আসে।
      নন্দিনী সহজ সুখ ও সহজ সৌন্দর্যের প্রতীক। সে সহজতা আমাদের জীবন থেকে চলে গিয়েছে। সহজতার অনুশীলন একান্তভাবে প্রয়োজনে টিকে থাকার জন্যে নয়, বেঁচে থাকার জন্যে। সে কথা বুঝেছিল রাজা। নিজের শক্তির অহংকারে রাজা নিজেকেই বন্দি করেছে। তার সে ‘বন্দিত্ব’ থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখাতে পেরেছে শুধু নন্দিনী। নন্দিনীকে আপনভাবে সকলে।
নাটকের শুরুতেই আমরা দেখি ‘রক্তকরবী’ ফুল এনে দিয়ে কিশোর নন্দিনীকে বলে –  “কীসের দুঃখ। একদিন তোর জন্যে প্রাণ দেব নন্দিনী, এই কথা কতবার মনে মনে ভাবি।”

      কিশোরের সঙ্গে কথোপকথনের পরেই নাটকে অধ্যাপকের প্রবেশ ঘটে। অধ্যাপক নন্দিনীকে বর্ণনা করে যক্ষপুরের আচমকা আলো হিসেবে। অধ্যাপকের সঙ্গে কথোপকথনে আমরা বুঝতে পারি নন্দিনী এখানকার নয়। নন্দিনী এই অন্ধকারের বুকে আলোর ঝলসানি। রঞ্জনকে সে বুকে নিয়ে আছে। নন্দিনীর সংলাপেই আমরা প্রথম ‘রঞ্জন’ এবং ‘রক্তকবরী’ এই দুটি শব্দ শুনি।
   রঞ্জন মুক্তির অনুপ্রেরণা আর রক্তকরবী মুক্তির প্রতীক। “রঞ্জন আমাকে কখনো-কখনো আদর করে বলে রক্তকবরী। জানি নে আমার কেমন মনে হয়, আমার রঞ্জনের ভালোবাসার রঙ লাল, সেই রঙ গলায় পরেছি, বুকে পরেছি, হাতে পরেছি।”

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন – “নন্দিনী সেই সহজ সুখের, সেই সহজ সৌন্দর্যের।”
নাটকে প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গে সহজ আলাপচারিতা নন্দিনীর সেই স্বরূপটিকে ফুটিয়ে তোলে। নন্দিনী আমাদের কাছে আরো বেশি প্রকাশিত হয় রাজার সঙ্গে কথোপকথন সূত্রে। সমস্ত যক্ষপুরীর সঙ্গে রাজার সম্পর্ক ভয়ের। কিন্তু সহজিয়া সুরে নন্দিনী রাজাকে বলে দিতে পারেন – “তুমি তো নিজেকেই জালে বেঁধেছ, তারপরে কেন এমন ছটফট করছ বুঝতে পারি নে।”
কিংবা – “তুমি নিজেকে সবার থেকে হরণ করে রেখে বঞ্চিত করেছ সহজ হয়ে ধরা দাও না কেন?”
     নন্দিনী নিজে সহজ হয়ে ধরা দিয়েছে প্রতিটি কোণে সহজ বিশ্বাসে, সে জানে রঞ্জন নিয়ে আসবে ছুটির বার্তা। রঞ্জনের কথা বলতে গিয়ে নন্দিনী আপ্লুত হয়ে পড়ে। তার স্থির বিশ্বাস রঞ্জন আসবে। কেউ তাকে আটকাতে পারবে না।
     নন্দিনীকে কেন্দ্র করে ‘রক্তকরবী’ নাটকে যেন দুটি প্রেমের ত্রিভুজ অঙ্কিত হয়েছে। প্রথম ত্রিভুজটি নির্মিত নন্দিনী রাজা ও রঞ্জনকে নিয়ে। দ্বিতীয় ত্রিভুজটিতে আছে নন্দিনী রঞ্জন ও বিশু। বিশুর সঙ্গে নন্দিনীর অদ্ভুত মরমী সম্পর্ক। বিশুর গান আসে যেন নন্দিনীর উদ্দেশ্যে। বিশুকে নন্দিনী বলেছে, দুঃখটির গান তুমি গাও, আগে আমি তার খবর পাইনি।

      নন্দিনীর সত্তা এমনি সহজিয়া সুরে বাঁধা যে সর্দারদের সঙ্গেও যেন তার ভাবের সম্পর্ক। সর্দারকে সে কুন্দফুলের মালা দিয়েছে। আসলে নন্দিনী এমনি এক নারী যা হৃদয়ে কারো প্রতি বিদ্বেষ নেই। সমস্ত ‘রক্তকরবী’ নাটকে নন্দিনী জড়িয়ে আছে। নাটকের প্রধান চরিত্রগুলোকে আমরা চিনেছি মূলত নন্দিনীর সঙ্গে কথোপকথনের সূত্রে। আর এভাবেই নন্দিনী নিজেও তার সম্পূর্ণ স্বরূপে পাঠক-দর্শকের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সহজিয়া নন্দিনী শুধু বিশু পাগলের কণ্ঠে গান জোগায় না, পরিস্থিতি সাপেক্ষে সে বিদ্রোহ জনতাকে নেতৃত্বও দিতে পারে। রাজার ঘরে রঞ্জনের মৃতদেহ দেখা নান্দনীর জীবনে চূড়ান্ত ট্র্যাজেডি। কিন্তু সেই বিপর্যের মুখে ভেঙে পড়া নয়, নন্দিনী বেছে নিয়েছে প্রতিরোধের পথ।

“নন্দিনী ॥ রাজা, এই বার সময় হল।
রাজা ॥ কিসের সময়?
নন্দিনী ॥ আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার লড়াই।
রাজা ॥ আমার সঙ্গে লড়াই করবে তুমি। তোমাকে যে এই মুহূর্তেই মেরে ফেলতে পারি।
নন্দিনী ॥ তারপর থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে আমার সেই মরা তোমাকে মারবে। আমার অস্ত্র নেই, আমার অস্ত্র মৃত্যু।”

নাটকের শেষে যক্ষপুরীর অচলায়তন ভাঙার অভিযানে নন্দিনী অগ্রবর্তিনী। 

       “রক্তকরবী” নাটকের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ এক নিয়ম ভঙ্গের পালাকে বুঝিয়েছেন। “অচলায়তন” এর যে নিয়ম ভাঙ্গার মধ্যে দিয়ে নতুনের আবির্ভাব হয়েছিল, এই নাটকেও নন্দিনীর প্রবেশের মধ্যে দিয়ে সেই নিয়ম ভাঙ্গা প্রস্তুত নিয়েছে এক নতুন রূপে। এতগুলো দিন যক্ষপুরীর মধ্যে যে সমস্ত মানুষ, কেবল জীবিত ছিল; তাদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে, নন্দিনী অর্থাৎ নতুনের আগমনের মধ্যে দিয়ে।