কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
কলমে – শ্রেয়সী মিশ্র, বাংলা (এম.এ), মেদিনীপুর কলেজ
বাংলা সাহিত্যের জগতে উজ্জ্বল নক্ষত্র মন্ডলে যে ত্রয়ী বন্দোপাধ্যায়ের পরিচয় আমরা পাই, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্র যুগের আভিজাত্য থেকে সরে এসে রাঢ় বাংলার আপামর নিম্নশ্রেনির মানুষদের দু্ঃখ,কষ্ট,আনন্দ প্রভৃতি অনুভূতির ডালি সাজিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যে।বাংলার চিরায়ত কথাসাহিত্যের অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু কথাসাহিত্যিক হিসেবেই নন,একজন বিদগ্ধ রাজনীতিবিদ হিসেবে ও ছিলেন অত্যাধিক পরিচিত। কথাসাহিত্যিক হিসেবে শরৎচন্দ্রের পরেই স্থান করে নিয়েছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। উপন্যাস, ছোটো গল্প মিলে বিচিত্র সব কাহিনী ও চরিত্র চিত্রন তৈরি করেছেন তিনি। বাংলা সাহিত্যের জগতে তাঁর অবদান কতখানি তা আর বলার অবকাশ রাখে না। তাঁর সময় কালে বাংলাদেশ থেকে একদিকে সামন্ততন্ত্র অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রের লোপ এবং অন্যদিকে ধনতন্ত্রের প্রভাব বিস্তার এই দুইকালের দ্বন্দ্বকেই রূপদান করেছেন তিনি তাঁর সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে। তৎকালীন রাঢ় বাংলার সকল বিষয়কে ভিন্ন ভিন্ন নিখুঁত চরিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর বিরাট সাহিত্য সম্ভার নিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্য জগতে চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবেন যুগ যুগ ।
◆ জন্ম ও বংশ পরিচয় :-
১৮৯৮ সালের ২৩ জুলাই তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত অধুনা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্ৰামে এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম ছিল হরিদাস বন্দোপাধ্যায় ও মাতার নাম ছিল প্রভাবতী দেবী। তাঁর বাবার বাগানের শখ ছিল অন্যদিকে প্রভাবতী দেবী ছিলেন আধুনিক রুচিসম্পন্না। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্র গঠনে তাঁর মা প্রভাবতী দেবীর প্রভাব ছিল যথেষ্ট। অন্য সাধারণ দশটি বাঙালি পরিবারের মতো তাঁর বেড়ে ওঠা। তাঁদের বাড়িতে নিয়মিত কালীপূজা হত। পিতা মাতা দুজনেই ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। মায়ের দয়ায় জাত বলেই তারাশঙ্কর নাম রাখা হয়েছিল। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতৃবিয়োগ হয় ১৩১৩ সালে আশ্বিন মাসে নবমীর দিন। হিসাব মতো সেটা ছিল ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স তখন মাত্র আট বছর। বাল্যকালে পিতাকে হারিয়ে তিনি মা এবং বিধবা পিসিমার আদর যত্নে লালিত হন। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে এসে উমাশশী দেবীর সঙ্গে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর দুই পুত্র সনৎকুমার ও সরিৎকুমার এর জন্ম যথাক্রমে ১৯১৮ ও ১৯২২ সালে হয়। এবং তিনকন্যা গঙ্গা, বুলু ও বাণীর জন্ম যথাক্রমে ১৯২৪,১৯২৬ ও ১৯৩২ সালে। মধ্যম কন্যা বুলু ১৯৩২ সালেই মারা যায়।
◆ শিক্ষা ও কর্মজীবন :-
পিতার মৃত্যুর পর পিসিমা সর্বদাই চাইতেন তারাশঙ্কর জমিদার হয়ে উঠুক, কিন্তু মাতা , প্রভাবতী দেবী চাইতেন জমিদারের বাইরে বহির্বিশ্বে তারাশঙ্করের বিচরন হোক। তারাশঙ্কর ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯১৬ সালে। আগের বছর পরীক্ষা দিয়ে ও পাস করতে পারেন নি। দ্বিতীয় বার ১৯১৬ সালে পরীক্ষা দিয়ে, দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন। ১৯১৬ সালে লাভপুরের যাদবলাল এইচ.ই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতায় আসেন। কলকাতায় এসে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন।যদিও তিনি শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারেন নি, কারন এই সময় তিনি বিপ্লবী দলের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সক্রিয় ভাবে যুক্ত থাকার কারণে ১৯৩০ সালে গ্ৰেপ্তার হলে ও পরে মুক্তি পেয়ে যান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তিনি পুনরায় আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু তখন ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপে শেষ পর্যন্ত তাঁর আর পড়া হল না। তিনি আবার লাভপুরে ফিরে আসেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনের শুরুর দিকে জনকল্যাণ মূলক কাজকর্ম ও রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলন যোগদান করে তিনি গ্ৰেপ্তার ও হন। জেল থেকে বেরিয়ে এরপর ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগলেন এবং মনোনিবেশ করলেন ছোটো গল্প ও উপন্যাস রচনায়।
◆ সাহিত্য জীবন :-
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত উপন্যাসের সংখ্যা প্রায় ৬০ টি । এছাড়া ও রয়েছে ছোটো গল্প , নাটক,প্রহসন, প্রবন্ধ, কাব্য ইত্যাদি।
ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাস সম্পর্কে বলেছেন –
“তাঁর উপন্যাসে মুমূর্ষু, সামন্ততান্ত্রিক ব্যক্তি, জীবন ও সমাজের ছবিটি অপূর্ব মমতায় বর্ণিত হয়েছে। একটা যুগের অবসান হচ্ছে আর একটা যুগ আসছে। পুরাতন গ্ৰামীন আবহাওয়া চলে যাচ্ছে আর সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে আসছে নতুন শিল্পপতির দল। সেই সামাজিক পরিবর্তনের দিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অপূর্ব দক্ষতার সহিত দেখিয়েছেন তাঁর প্রধান প্রধান উপন্যাসে ও ছোটো গল্পে”।
তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস চৈতালী ঘূর্ণি (১৯৩২),
এই উপন্যাস সম্পর্কে প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছেন,
“তারাশঙ্কর সাহিত্য জীবনে রাঢ়ের গ্ৰামাঞ্চল নিয়ে বহু সার্থক ও সুবৃহৎ উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু সে সমস্ত উপন্যাসের প্রায় তাবৎ উপাদানই বীজাকারে যেন তুলনায় নিতান্ত ক্ষুদ্রাকার চৈতালী ঘূর্ণির মধ্যেই সঞ্চিত।”
পরবর্তী উপন্যাস –
পাষাণপুরী (১৯৩৩), নীলকন্ঠ (১৯৩৩), রাইকমল(১৯৩৫), প্রেম ও প্রয়োজন(১৯৩৬), আগুন(১৯৩৮), ধাত্রীদেবতা(১৯৩৯), কালিন্দী(১৯৪০), গণদেবতা(১৯৪৩), মন্বন্তর(১৯৪৩), পঞ্চগ্ৰাম(১৯৪৪), কবি (১৯৪৪), সন্দীপন পাঠশালা (১৯৪৬), অভিযান (১৯৪৬), ঝড় ও ঝরাপাতা (১৯৪৬), পদচিহ্ন (১৯৫০), উত্তরায়ন (১৯৫০), হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৫১), তামসা তপস্যা (১৯৫২), নাগিনী কন্যার কাহিনী(১৯৫২), আরোগ্য নিকেতন (১৯৫৩), চাঁপা ডাঙার বৌ (১৯৫৪), পঞ্চপুত্তলি(১৯৫৬), বিচারক(১৯৫৭), সপ্তপদী(১৯৫৮), বিপাশা(১৯৫৯), রাধা(১৯৫৯), ডাকহরকরা (১৯৫৯) , মহাশ্বেতা (১৯৬১), না(১৯৬১), নাগরিক (১৯৬১), নিশিপদ্ম(১৯৬২), যতিভঙ্গ(১৯৬২), কান্না(১৯৬২), কালবৈশাখী (১৯৬৩), গুরুদক্ষিণা (১৯৬৬), ছায়াপথ(১৯৬৯), কালরাত্রি(১৯৬৯), রূপসী বিহঙ্গিনী (১৯৭০), অভিনেত্রী(১৯৭০), ফরিয়াদ(১৯৭১), সুতপার তপস্যা(১৯৭১), একটি কালো মেয়ের কথা (১৯৭১), নবদিগন্ত (১৯৭৩) ।
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটো গল্প প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক চিঠিতে লিখেছেন –
“তোমার ছোটো গল্পের কতকগুলি আমার বেশ ভালো লেগেছে – দু একটা আছে কষ্টকল্পিত। তোমার স্থূলদৃষ্টির অপবাদ কে দিয়েছে জানি নে কিন্তু আমার তো মনে হয় তোমার লেখায় সূক্ষ্মস্পর্শ আছে ,আর তোমার কলমে বাস্তবতা সত্য হয়েই দেখা দেয় , তাতে বাস্তবতার কোমর বাঁধা ভান নেই। গল্প লিখতে বসে গল্প না লেখাটাকে ই যাঁরা বাহাদুরি মনে করেন তুমি যে তাদের দলে নাম লেখাও নি এতে খুশি হয়েছি।লেখার অকৃত্রিমতাই সবচেয়ে দুরূহ”।
তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য গল্পগুলি হল –
ছলনাময়ী (১৯৩৭), জলসাঘর (১৯৩৮), রসকলি(১৯৩৯), তিনশূন্য(১৯৪২), প্রতিধ্বনি(১৯৪৩), বেদেনী(১৯৪৩), দিল্লী কি লাড্ডু(১৯৪৩), যাদুকরী (১৯৪৪), স্থলপদ্ম(১৯৪৪), তেরশো পঞ্চাশ(১৯৪৪), প্রসাদমালা(১৯৪৫), হারানো সুর (১৯৪৫), ইমারত(১৯৪৭), রামধনু (১৯৪৭),শ্রীপঞ্চমী(১৯৪৯), কামধেনু (১৯৪৯), মাটি (১৯৫০), শিলাস্থান(১৯৫২), বিস্ফোরন(১৯৫৫),কালান্তর(১৯৫৬), বিষপাথর(১৯৫৭), রবিবারের আসর(১৯৫৯), পৌষলক্ষী(১৯৬১),আলোকআভিসার(১৯৬২), চিরন্তনী (১৯৬২), অ্যাক্সিডেন্ট(১৯৬২), তমসা(১৯৬৩), আয়না (১৯৬৩),চিন্ময়ী(১৯৬৪), একটি প্রেমের গল্প(১৯৬৫), নারী রহস্যময়ী(১৯৬৭),সিংহের ঘোড়া(১৯৬৮), জয়া(১৯৬৮), মিছিল(১৯৬৯), উনিশশো একাত্তর (১৯৭১)।