পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসের গ্রামীন সমাজ ব্যবস্থা

কলমে – পূজা দাস, এম.এ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)


    প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে পৃথিবীজুড়ে যে মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকটময় মুহূর্তে সৃষ্টি হয়েছিল, বাংলা কথা সাহিত্যের ধারায় যেসব লেখক গনের হাতে বাংলা সাহিত্যের বৈপ্লবিক ধারার সূচনা হয়েছিল মানিক  বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনকে দেখেছেন বাস্তবের ভূমিতে দাঁড়িয়ে, বাস্তবের গভীরে ঝাঁপ দিয়ে তিনি জটিলতাকে ধরতে চেয়েছেন। অভ্যস্ত জীবনযাত্রা শৃঙ্খলের মধ্য দিয়ে নয়, দুর্দমনীয় জীবন প্রবাহের মধ্য তিনি রহস্যের অনুসন্ধান করেছেন। তাই তাঁর রচনার মূল বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, নিয়তিবাদ।
      ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বাংলা কথা সাহিত্যের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কোন শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গি স্বতন্ত্র স্বয়ং নির্ভর নয়, তা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে সেই শিল্পীর নিজের দেশকালের পরিপ্রেক্ষিতে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন প্রভাবিত হয়েছে একজন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবন সমুদ্রের তরঙ্গাঘাতের ক্ষুব্ধ ফেনিলতায়। এ সময়‌ পুরানো পৃথিবীর প্রচলিত ঐতিহ্য আর বিশ্বাস, মনন আর মূল্যায়ন একটা প্রকাণ্ড ভাঙন রূপান্তরের মুখোমুখি। এর‌ই ফলশ্রুতিতে সভ্যতার ভারকেন্দ্র সহজ গ্রামীণ জীবন থেকে ক্রমশ সরে এসেছে নাগরিক জীবনে, পুরোনো ধর্মবিশ্বাস, সংস্কার ও নীতিবোধের পরিবর্তে যুক্তির মর্মবেদী আলোতে তারা সবকিছুকে নতুন করে যাচাই করতে শুরু করেছে। এই সংশয়, জিজ্ঞাসা, বুদ্ধিজীবী মানুষের আদর্শের দ্বন্দ্ব, বিক্ষোভ, হতাশা মানুষের মধ্যে তীব্রতর করে তুলেছে রাজনৈতিক সংগ্রাম চেতনা, সেখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসে’র।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের পরিচিতি: 
     কল্লোলের যুগে বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে প্রধান ঔপন্যাস হলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর রচিত তৃতীয় ‌উপন্যাস ‌ও চতুর্থ মুদ্রিত গ্রন্থ হল ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসটি।  উপন্যাসটি ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় বাংলা ১৩৪১ সালের পৌষ মাস থেকে ১৩৪২ সালের অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।  উপন্যাসটি প্রথম সংস্করণ গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয় ২১শে মে ১৯৩৬ সালে (জৈষ্ঠ ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে)। প্রকাশক ছিল- ডি. এম লাইব্রেরী,কলকাতা। গ্রন্থে প্রচ্ছদ শিল্পীর কোন উল্লেখ ছিল না। ঠিক এর ১১ বছর পর উপন্যাসের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসের (বাংলায় কার্তিক ১৯৫৪ বঙ্গাব্দে) প্রকাশক ছিলেন চিন্মোহন সেহানবীশ কর্তৃক দি বুকম্যান, কলকাতা। প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন মাখন দাশগুপ্ত। উপন্যাসটি মূলত সমাজতাত্বিক মূলক উপন্যাস।  যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো গ্রামের শশী ডাক্তার সে শহরে পড়াশোনা শিখে ডাক্তারি বিদ্যার আয়ত্ত্ব করছে, তাই তার গ্রামের মানুষের কুসংস্কার, ঈশ্বরের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস তার নেই। এছাড়াও গ্রামের পটভূমিতে শশীর পিতা গোপাল দাস, পরান, পরানের বোন মতি, কুসুম চরিত্র গুলির মাঝে বিদ্যমান জটিল সামাজিক সম্পর্কে উত্থান পতন নিয়েই‌ গড়ে উঠেছে উপন্যাসটির কাহিনী ও প্রেক্ষাপট। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তৎকালীন গ্রাম বাংলার ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রেম, বিরহ, দ্বেষ ও পারস্পরিক সহমর্মিতাকে উপজীব্য করে লেখা এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

উপন্যাসে গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা:
       ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসটিতে অঙ্কিত হয়েছে গাওদিয়া গ্রামের জীবনযাত্রা প্রণালী ও বিশেষ কয়েকটি সমস্যার যে ছবি তা যেন আমাদের সাধারন পল্লী সমাজের‌ই একটা অ‌ংশ। এবং এই ছবি মূলত পুতুল নাচের ইতিকথার নায়ক শশীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে।

    গাওদিয়ায় ভৌগোলিক যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে গ্রামে যেতে পুল পার হতে হয়।  কলাবাগান, সুপারি বাগানে ঘেরা সম্পন্ন মানুষের বসতি। সেখান থেকে ভেসে আসে কামিনী, জবা, গন্ধরাজ ফুলের সুবাস, গ্রামে ঢোকার পথ চওড়া হলেও কাঁচা। গ্রাম জীবনকে মেনে নিলেও বন্ধু পত্নী পরানের স্ত্রী কুসুমের পরকীয়া প্রণয়কে মেনে নিতে পারেনি শশী, শিক্ষিতের কুন্ঠা থেকে তাকে সামাজিক দোলাচলে ফেলে দিয়েছে।  উভয়ের মধ্যে মনের মিল না থাকলেও, মুক্তির স্থান ছিল অভিন্ন সেই তালবন। 

    গাওদিয়া গ্রামে সর্বস্তরের মানুষের শ্রেণী পরিচয়ের বিন্যস্ত হয়েছে একদিকে যেমন আছেন শশীর বাবার মত মহাজন শ্রেণীর মানুষ গোপাল দাস ,অন্যদিকে আছে যাদব পন্ডিত, কবিরাজ যামিনীর মতো উচ্চবিত্তের গ্রামীণ মানুষ। এছাড়াও আছে কায়েত শ্রীনাথ মুদি, বাগদী, সদগোপ ইত্যাদি নিম্নবিত্তের মানুষজন।  কৃষকভিত্তিক পদাধিকারীর মধ্যে হলেন জমিদার শীতলবাবু ও তার ভাই বিমল বাবু, এছাড়াও কর্ম বিভাজনের উল্লেখও পাওয়া যায়।

     উপন্যাসের সূচনা হয়েছে গাওদিয়া গ্রামের‌ একটি বট গাছের চিত্র দিয়ে। গ্রামের মানুষের যাতায়াত বা বসবাস এদিকে নেই, কারণ ‘গ্রামের লোক ভয় পেতে ভালবাসে’ এই ভালোবাসার ভয়ে গড়ে ওঠে গ্রামের মানুষের কুসংস্কার। ভিন্ন গাঁয়ের সাপুড়ে আসে, এদিকে যামিনী কবিরাজের চেলারা গুল্মলতা পাতা কুড়িয়ে নিয়ে যায়। গ্রামীন পরিবেশের চিহ্ন পাওয়া যায় গোবর্ধনের ভূত দেখার প্রসঙ্গে।

গ্রামীন মানসিকতায় অন্ধবিশ্বাস, অলৌকিকতা ছবি চিত্রিত হয়েছে সেন দিদি ও যাদব পন্ডিতকে ঘিরে। গ্রামীণ মানুষের কাছে  শ্রদ্ধাভক্তি বজায় থাকার লোভে ঘোষিত দিনকে বাস্তবতা দানের জন্য যাদব পন্ডিতের আফিম খেয়ে মৃত্যু আর পাগলা দিদির সেই সঙ্গে অনুসৃতা হয়ে অন্ধ ভক্তির জগতে সিদ্ধা রমনীতে পরিণত হ‌য়। যাদব পন্ডিতের মৃত‍্যুকে ঘিরে উত্তপ্ত গাওদিয়াকে শান্ত করতে পারেনি চিকিৎসক শশী। গ্রামীণ জনমতের অন্ধবিশ্বাসের কাছে বিজ্ঞান হেরে যেতে বাধ‍্য হয়েছে। এক‌ইভাবে শ্রীনাথের মেয়ের বকুলতলায় ফেলে যাওয়া ন‍্যাকড়া জড়ানো পুতুল দেখে শশী অনমান করে নিঃসন্তান সেনদিদি ভোরবেলা ঝাঁট দিতে এসে পরম মমতায় পুতুলটিকে তুলে নিয়ে যাবে। এর‌ও নীরব নিভৃত দর্শক হয়ে থেকে যাবে শশী।

অন্যদিকে আছে দিদি সম্পর্কে গ্রামীণ সমাজে কলঙ্ক আর লোকনিন্দা। যামিনী সম্পদ কবিরাজের আত্মহনন ও বিন্দুর ব্যাভিচারিণী আচরণ শশীর সামাজিক জীবনের অন্যতম প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। যার কারণে গোপাল সেনদিদির শিশু সন্তান নিয়ে কাছে চলে যেতে বাধ্য হয়।

     কিন্তু শশী শহর থেকে পাশ করা ডাক্তার, সে এইসব কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস মানে না। শশী হলো এখানে দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালের নিদারুণ অপচয় থেকে উঠে আসা এক নায়কের নাম। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে যে হয়ে উঠেছে শশী ডাক্তার। তার লড়াই শুধু ক্রমাগত ডাক্তার হিসেবে মৃত্যুর বিরুদ্ধে নয়, তার লড়াই ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন অশিক্ষিত মানুষেরঅশিক্ষিত মানুষদের শিক্ষিত করার, সংস্কার থেকে মুক্ত করার লক্ষ্য।

      শশীর গ্রাম গাওদিয়া মানুষজনের বিশ্বাস ছিল- “সংসারের মানুষ চায় এক আর হয় আর এক। চিরকাল এমনি দেখে আসছি ডাক্তারবাবু। পুতুল বই তো নই আমরা একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছে”। এই সংস্কারের কাছ থেকে, অবিদ্যার কাছ থেকে, অদৃষ্ট বা নিয়তির কাছ থেকে গাওদিয়ার মানুষজনকে শশী টেনে বের করে আনতে চেয়েছিল, তার বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। শশীর ডাক্তার হয়ে গ্রামে আসার অর্থ কুসংস্কারে মৃত গ্রামটিকে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার মাধ্যমে নতুন করে প্রাণ দান। ধীরে ধীরে শশীর মনেও জন্ম নিয়েছিল “জীবনকে বৃহত্তর ব্যাক্তি দিবার পিপাসা”।  সে প্রথমে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি – “এই সব অশিক্ষিত নরনারী, ডোবাপুকুর, বন জঙ্গলমাঠ, বাকি জীবনটা তাহাকে এখানেই কাটাইতে হইবে নাকি?” – কিন্তু যে শশী একদিন সংকীর্ণ গ্রাম্যজীবন থেকে মুক্ত পাবার জন্য ছটফট করেছে ,সেই একদিন যাদব পন্ডিতের দানের টাকায় গ্রামে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছে। যে একদিন এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল সেই একদিন হয়ে উঠল এই গ্রামের সব থেকে বড় দায়িত্বশীল কর্মী।
     উপন্যাসে গাওদিয়ার গ্রাম গাওদিয়ার গ্রামজীবনের সংকীর্ণ চৌহদ্দির মধ্যে মলিন প্রাত্যহিক জীবনচর্চার প্রণালী, অল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত, গেঁয়ো পুকুরের ঢেউ ও মানুষের হকে বাঁধা জীবনের ইতিকথার আলোকেই শশী দ্বন্দ্ব সংঘাত‌ও শেষ পর্যন্ত নির্বিধে পৌঁছানোর ইতিহাস বর্ণনা করেছেন ঔপন্যাসিক। উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র মানুষ। সেই মানুষের যেমন ব্যক্তি পরিচয় আছে, তেমনি সামাজিক পরিচয়‌ও রয়েছে। শশীর অস্তিত্বের সংকট, নিঃসয়তা ক্লান্তি বোধের মূলে  রয়েছে গ্রামীণ জীবনের জট।  শশীর অস্তিত্বের সংকটের মূল কারণ গ্রাম ও শহরের দ্বৈত মানসিক অবস্থান। গ্রাম থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য সে শহরে যায়, শহরের শিক্ষা শশীর সংকীর্ণ হৃদয়, ভোঁতা চিন্তাশক্তি, কল্পনার জগৎকে প্রসারিত করল নাগরিক জীবনের বৈচিত্র্য। স্বপ্নহীন, আদর্শহীন গাওদিয়ার জীবনকে যখন শশী তার স্বপ্নের মতো গড়তে চাইলো তখন সেও নিজের সাথে নিজের যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল। তার ভাবনায় – “প্রথমে সে যেন হাঁপাইয়া উঠিল। জীবনটা কলকাতার যেন বন্ধুর বিবাহের বাজনার মত বাজিতেছিল, সহসা স্তব্ধ হ‌ইয়া গিয়াছে।”

    “মাটির টিলাটির উপর উঠিয়া সূর্যাস্ত দেখিবার শখ এই জীবনে আর একবারও শশীর আসিবেনা” –  উপন্যাসের পরিনতিতে শশীর সর্বময় পরাভব প্রমাণিত হয়েছে। শশীকে ছেড়ে একে একে সকলে বিদায় নিয়েছে। তার সামাজিক ও বৌদ্ধিক পরিশীলনের কাছে কুসুমের শরীরী আকুলতা পরাভূত হয়ে শুকিয়ে গেছে। বিমূঢ় শশীর অন্তিম আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে কুসুম জানিয়ে গেছে “উত্তপ্ত লোহাও একদিন ঠান্ডা হয়ে যায় ছোট বাবু”- এই জীবন সত্য।
      হারু ঘোষের গোটা পরিবার নিয়েই কুসুম বিদায় নিয়েছে, গোপাল বিষয় সম্পত্তির ভার ছেলের হাতে চাপিয়ে সেন দিদির অবৈধ সন্তান নিয়ে বিদায় নিয়েছে। বাসুদেব বাড়ূয্যে গ্রাম ত্যাগ করে চলে গেছে কলকাতায়, বিন্দু ফিরে গেছে নন্দর কাছে, মতি কুমুদের নীড়হারা প্রেমের সঙ্গী হয়েছে, মৃত্যুর মাধ্যমে বিদায় নিয়েছে শশীকে সমীহ করা অনেকেই। আত্ম প্রতিষ্ঠা চূড়ান্ত প্রান্তে পৌঁছে শশীকে ফিরে যেতে হয় নিঃসঙ্গতায়, পরাজয়ে। তবু এ অদৃশ্য ভাগ্যের হাতে মানুষের পরাভব নয়।

    

সমালোচক  বুদ্ধদেব বসু ঔপন্যাসিকের কথার সূত্র ধরে লিখেছেন  –
“মানিক নিজে ‘পুতুল নাচের ইতিকথার’ মানুষগুলিকে ভাগ্যের দাস বলে মেনে নেননি। মনে করেছেন – ‘মানুষকে যারা পুতুলের মত নাচায় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ’।… গাওদিয়া গ্রামের পশ্চাদপদ বদ্ধতা জানিত অসহায়তা থেকে উদ্ধার পাবার জন্য শশীর যুক্তিবাদী মন মানিকের মতোই খুঁজে বেরিয়েছে মানুষের স্বাস্থ্য সংস্কার শিক্ষিত জীবন। পরাজিত হয়েও লড়াই করেছে।”

শশীর সেই পরিশীলিত মনও শেষ পর্যন্ত নিয়ত যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়েও গাওদিয়া গ্রামের গাছপালা, বাড়িঘর, ডোবা পুকুর, সংস্কারের ভিত্তিতে মানুষজন সবই তাকে এক মায়াবী আকর্ষণে জড়িয়ে রাখে।

      মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে গ্রাম্য জীবনের একাধিক চিত্র থাকলেও ‌এর মূল সুর ছিল জীবন চেতনা। জীবনের সমগ্র তাকে পেতে গেলে মৃত্যু চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে পেতে হবে। মৃত্যু চেতনাকে বাদ দিয়ে জীবন চেতনা কখনোই পূর্নতা পায় না। নশ্বর জীবনকে মৃত্যুর পটভূমিতে দেখার একটা অভিলাষ ‌এই উপন্যাসে সক্রিয়। তাই উপন্যাস শুরু হয়েছে একটা নৈব্যক্তিক অসহায় মৃত্যু দৃশ্য দিয়ে। এই উপন্যাসে শশীর সমস্যা যৌন সমস্যা নয়,মনের সমস্যা। শশীর জীবনে ও মনে গাওদিয়া গ্রামের জটিল প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে গাওদিয়া রূপময় হয়ে ওঠে। শশীর স্বপ্নে রয়েছে আনন্দয় জীবন, বিলাশময় জীবন, নাগরিক জীবন আর তার বাস্তবে রয়েছে গ্রামীন অর্থনৈতিক কাঠামোই পিতৃতান্ত্রিক বশ্যতা। –“এ সুদুর পল্লীতে হয়তো সে বসন্ত কোনোদিন আসিবে না, যাহার কোকিল পিয়ানো,সুবাস এসেন্স,দক্ষিণা ফ্যানের বাতাস–“ শশীর স্বগত চিন্তার প্রতিফলনে ফুটে ওঠে নাগরিক জীবনের ব্যগ্রতা। শশীর বাস্তবতা কলকাতা নয়, এই গাওদিয়া এটা সে মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গেলেও উপন্যাসের পঞ্চম পরিচ্ছেদে দেখা যায়- গাওদিয়া ভাবনার ‌একটা পরিবর্তন – “জীবনকে দেখিয়া শিখিয়া,অত্যন্ত অসম্পূর্ণ ভাসা ভাসা ভাবে জীবনকে দেখিতে শিখিয়া, সে আবাক হ‌ইয়া দেখিয়াছে এইখানে এই ডোবা আর মশা ভরা গ্রামের জীবন কম গভীর নয়,কম জটিল নয়।”

উপন্যাসের ‌এই প্রকৃতি চেতনা উপন্যাস ও ঔপন্যাসিকের ‌এক বিশিষ্ট সম্পদ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃতি দৃষ্টির ভেতরে যে শিশুর ‌আনন্দ ও ঋষির বিস্ময় ক্রিয়াশীল ছিল মানিক বন্দোপাধ্যায়ের প্রকৃতি চেতনা সে আনন্দ বিস্ময়ের সঙ্গে বস্তুত সম্পর্কহীন। এই প্রকৃতি নিয়তির মতো নিষ্ঠুর, বৈরাগীর মতোই অনাসক্ত।
     শশীর গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে ডাক্তার হ‌ওয়া, তারপর গ্রামে ফেরা, গ্রামে ফিরেও শহরবাসের জন‍্য কাঙালপনা, গ্রামীন মানুষের সংস্কার কুসংস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া, ক্রমে তার আশেপাশের গ্রামীণ মানুষগুলির তাকে ছেড়ে চলে যাওয়া এবং গ্রামে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন – এই সমস্ত ঘটনাকে কেন্দ্র মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথায় গ্রামীণ জীবন ও সমাজকে আবর্তিত করেছেন।
      শরৎচন্দ্রের গ্রামজীবন মানুষের বর্ণনায় উপস্থাপিত, বিভূতিভূষণের লেখনীতে গ্রাম উঠে এসেছে মানুষের জীবনের বর্ণনা নিয়ে আর মানিক গ্রাম জীবনকে উপস্থাপিত করেছেন চরিত্রের বিশ্লেষণের নিয়ামক রূপে। এখানেই মানিক স্বতন্ত্র এবং এই দৃষ্টিকোণেই পুতুল নাচের ইতিকথা উপন‍্যাসে গ্রামজীবনের সার্থক রূপায়ণ।