ঐতিহাসিক উপন্যাস : তুঙ্গভদ্রার তীরে

কলমে – পূজা দাস; স্নাতকোত্তর (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)


      “ইতিহাসের সংস্রবে উপন্যাসে একটা বিশেষ রস সঞ্চার করে, ইতিহাসের সেই রসটুকুর প্রতি ঔপন্যাসিকের লোভ, তাহার সত্যের প্রতি তাহার কোন খাতির নাই। কেহ যদি উপন্যাসে ইতিহাসের সেই বিশেষ গন্ধটুকু এবং স্বাদটুকুতে সন্তুষ্ট না হইয়া তাহা হইতে অখন্ড ইতিহাস-উদ্ধারে প্রবৃত্ত হন তবে তিনি ব্যঞ্জনের মধ্যে আস্ত জিড়ে-ধনে-হলুদ-সরষে সন্ধান করেন; মশলা আস্ত রাখিয়া যিনি ব্যঞ্জনের স্বাদ দিতে পারেন তিনি দিন, যিনি বাঁটিয়া ঘাঁটিয়া একাকার করিয়া থাকেন তাহার সঙ্গে আমার কোনো বিবাদ নাই, কারণ স্বাদই এ স্থলে লক্ষ্য, মশলা উপলক্ষ মাত্র।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) 

     রবীন্দ্র সমসাময়িক ঐতিহাসিক সাহিত্যিকদের মধ্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরই যাঁর নাম উঠে আসে তিনি হলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে যে সমস্ত সাহিত্যিক তাঁদের নিরন্তন প্রচেষ্ঠার দ্বারা সমৃদ্ধতর করে তুলেছেন কথাসাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাঙালির ঘরে ঘরে সমাদৃত অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ তাঁর কলমের স্পর্শেই হয়ে উঠেছে পাঠকদের সেরা গোয়েন্দা গল্পের অন্যতম। তবে শুধুমাত্র গোয়েন্দা কাহিনী নয়, ঐতিহাসিক রচনা লেখাতেও তিনি বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। তিনি উপন্যাসের আঙ্গিকে ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলো হল – ‘কালের মদিরা’, ‘গৌড় মোল্লার’, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ, ‘কুমার সম্ভবের কবি’, ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’।  আমাদের আলোচ্য বিষয় ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসটি।

‘তুঙ্গভদ্রার তীরে উপন্যাসের পরিচয়:
শরদিন্দু  বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত প্রখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস হলো ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’।  প্রতিটি ঐতিহাসিক উপন্যাসের মূল কাহিনী নিহিত থাকে কোনো না কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা বা গ্রন্থের মধ্যে। ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসটির কাহিনী ঐতিহাসিক পটভূমি গ্রহণ গ্রহণ করা হয়েছে Robert swell- এর ‘Forgotton Empire‘ গ্রন্থ এবং কয়েকটি সমসাময়িক পান্থলিপি থেকে।  মনে করা হয় swell এর এই গ্রন্থ গুলি প্রায় ৬৫ বছরের পুরানো। ঔপন্যাসিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় swell-এর তথ্যগুলি সংগ্রহ করেছিলেন ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত ‘The Delhi Sultanate’ পাঠ করে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসটি রচনা করতে সময় লেগেছিল ২১শে জুলাই ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৭ই এপ্রিল ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। অবশেষে প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় পয়লা অগ্রহায়ণ ১৩৭২ বঙ্গাব্দে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। তারপর বিংশ মুদ্রণ প্রকাশিত হয় ১৪২৩বঙ্গাব্দে ফাল্গুন মাসে।
উপন্যাসটি উৎসর্গ করা হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের বিক্রমশীল ধর্মপাল শ্রী প্রমথনাথবিশী সহৃদবরেষু। ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসটি শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৭২ সালে। উপন্যাসে ঐতিহাসিক চরিত্র থাকলেও কাহিনী নির্মাণ করা হয়েছে মৌলিকভাবে; উপন্যাসটির ঘটনাকাল অনুমান করা যায় ১৪৩০- এর আশেপাশে। উপন্যাসের প্রচ্ছদ অঙ্কন করেছিলেন অজিত গুপ্ত।
বিজয় নগর রাজ্যকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি রচিত হয়েছে। সেই রাজ্যের রাজা দ্বিতীয় দেবরায় এবং কলিঙ্গ দেশের রাজকন্যা কুমারি ভট্টারিকা বিদ্যুৎমালা ও মনিকঙ্কণা, অর্জুন বর্মাকে নিয়ে নানানানা দিক থেকে উপন্যাসটি রচিত হয়েছে। ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসটি পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হয়।

‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু:
       শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের “তুঙ্গভদ্রার তীরে” উপন্যাসটি ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাস।উপন্যাসটি শুরু হয়েছে তুঙ্গভদ্রার ভৌগোলিক পরিচয় দিয়ে। সেখানে উপন্যাসিক তুঙ্গভদ্রার ভৌগোলিক বর্ণনা ও ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। এই সূচনা অংশের পরেই মূল কাহিনি সূত্রপাত হতে দেখা যায়। উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায়, বিজয়নগরের পথে চলেছেন দুই রাজকুমারী ভট্টরিকা বিদ্যুৎমালা ও তার বৈমাত্রেয় বোন মনিকঙ্কণা। তাদের বিজয় নগরে যাবার উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎমালার সঙ্গে রাজা দ্বিতীয় দেবরায় বিবাহ। কিন্তু হঠাৎ করে তুঙ্গ ভদ্র জলে ভেসে ওঠে অজ্ঞাত পরিচয় যুবক‌ অর্জুন বর্মা। যাকে উদ্ধার করে আনে বলরাম দাস নামক এক কলিঙ্গ প্রজা। এরপর নানা কাহিনীর মধ্য দিয়ে হঠাৎ এক সময়ে ঝড় আসে আর সেই ঝড়ে বিদ্যুৎমালা, মন্দোদরী ও মাতুল চিপিটক জলে পড়ে যায় আর বিদ্যুৎমালাকে রক্ষা করে অর্জুন বর্মন।  অবশেষে বিদ্যুৎমালা আর মনিকঙ্কনা নিঃসংকটে বিজয়নগরে পৌঁছায়। এরপর কাহিনী পরম্পরাগত ভাবেচলতে থাকে, যেমন বিজয় নগরে রাজদূত হিসাবে অর্জুন বর্মা এবং কর্মকার হিসেবে বলরামের নিয়োগ। কুমার কম্পনদেব কর্তৃক মহারাজকে হত্যার চেষ্টা, অর্জুনের তৎপরতায় রাজা দ্বিতীয় দেবরায়য়ের প্রান রক্ষা, বিদ্যুৎমালা ও অর্জুন বর্মার প্রেম, কুপিত মহারাজ দ্বিতীয় দেবরায় কর্তৃক অর্জুন বর্মাকে বিজয়নগর তাগের আদেশ, বলরামও বন্ধুর পথ বেছে নিলেন, বিজয়নগর ছেড়ে যাওয়ার পথে মুসলমানদের ষড়যন্ত্রের খবর দিতে পুনর্বার অর্জুন বর্মার বিজয়নগরের প্রত্যাগমন। অবশেষে দ্বিতীয় দেবরায়য়ের সাথে মনিকঙ্কনার ও অর্জুন বর্মার সাথে বিদ্যুৎমালার শুভ পরিনয় ঘটে, তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। এইখানেই ঔপন্যাসিক কাহিনীর সমাপ্ত করেন।

   শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ চারটি পর্বে বিভক্ত। এই চারটি পর্বকে প্রতিটি উপপর্বে বিভক্ত করা যায় –
প্রথম পর্বে ১১টি উপপর্ব,  দ্বিতীয় পর্বের ৯টি উপপর্ব,
তৃতীয় পর্বের ৬টি উপপর্ব এবং  চতুর্থ পর্বে ৮ টি উপপর্ব আছে।
পর্বগুলিতে যে যে ঘটনাগুলো বিদ্যমান যেমন প্রথম পর্বের চার নম্বর উপপর্বে- অর্জুন বর্মার আবির্ভাব, তারপরে প্রথম পর্বের ৯ নম্বর উপপর্বে- বিজয় নগরের প্রবেশ ও গ্রীষ্মকালীন ঝড়, তৃতীয় পর্বের দুই নম্বর উপপর্বে- অর্জুন বর্মার পিতা রাম বর্মার মৃত্যুর সংবাদ, তৃতীয় পর্বের তিন নম্বর উপপর্বে – হুক্ক-বুক্কের আবির্ভাব, তৃতীয় পর্বের ছয় নম্বর উপপর্বে- রাজপিতা ও কম্পন রায়ের মৃত্যু, চতুর্থ পর্বের দুনম্বর উপপর্বে – অর্জুন বর্মার নির্ব‌াসন, চতুর্থ পর্বের ছ নম্বর উপপর্বে- যুদ্ধ প্রস্তুতি ও যাত্রা এবং চতুর্থ পর্বের ৭নম্বর উপপর্বে – বিবাহের দৃশ্য দেখা যায়।

ঐতিহাসিক উপন্যাসের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য: 
       উপন্যাস হল বাংলা কথা সাহিত্যের দীর্ঘায়ব বর্ণাত্মক মূলক গদ্য লেখা। এক কথায়, উপন্যাস হল আধুনিক জীবনের গদ্য কাব্য। কবিতা, নাটক ও ছোট গল্পের ন্যায় উপন্যাস ও সাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা। উপন্যাসে পরিবেশ, বর্ননা, রূপরেখা, চরিত্র, সংলাপ ইত্যাদি মানুষের জীবনের কাহিনীকে সুন্দর ও সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলে, তার মধ্য জীবনের কোন অর্থ বা ভাষা প্রকাশ করা হয়। এই উপন্যাস আবার বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। বিষয় চরিত্র, প্রবণতা ও গঠনগত সৌকর্যের ভিত্তিতে উপন্যাসকে নানা শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যেমন- সামাজিক উপন্যাস, রাজনৈতিক উপন্যাস, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস, ঐতিহাসিক উপন্যাস, আঞ্চলিক উপন্যাস ইত্যাদি। এদের মধ্যে আমাদের আলোচ্য বিষয় হল –  ঐতিহাসিক উপন্যাসের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য।
ঐতিহাসিক ‌উপন্যাসকে নিদিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় বিভূষিত করা যায় না। তাই আমরা এর আঙ্গিক ও বিষয়ের উপর দৃষ্টি রেখে ধারণাগত একটা সংজ্ঞা রচনা করতে পারি,  ইতিহাসের কাহিনী ও চরিত্রকে আশ্রয় করে লেখক যখন‌ ইতিহাসের অন্তর লোকে উঁকি দিয়ে একটি বিশেষ যুগ ও তার কিছু ঘটনা এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের দ্বিধা- দ্বন্দ্ব, আশা-নিরাশার কথা ফুটিয়ে তোলেন, তখন তাকে বলা হয় ঐতিহাসিক উপন্যাস। বস্তুত বিশাল পটভূমিতে পারিবারিক জীবনের ছবি আঁকা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে তৎকালীন দৈনন্দিন জীবনের সংযোগ সাধনের অনিবার্যতাও বুঝে নেওয়া অনেক সময় সহজ হয় না।
ঐতিহাসিক উপন্যাসের এই ধারণা থেকে এবং অন্য সকল উপন্যাসের পৃথক ধারা থেকে এই ধারাকে স্বতন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে, অবশ্যই  এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকা বাঞ্ছনীয়। ঐতিহাসিক উপন্যাসের বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য গুলি হল-
1. সমসাময়িক জীবনের বিষয়বস্তু বা বাস্তব চরিত্রসমূহের পরিবর্তে ঐতিহাসিক উপন্যাসে বেছে নেন অতীত ইতিহাসের কোন একটি বিশেষ সময়ের পর্বকে।
2. ঐতিহাসিক উপন্যাসের যে বর্ণিত যুগ তথা ঘটনা- কাহিনীর প্রতি তাকে বিশ্বস্ত থাকতে হয়, সেই সময় সেই কালের রীতি-নীতি, আচার- ব্যবহার, সংস্কার, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি সকল বিষয়ে লেখককে সচেতন থাকতে হয়।
3.  ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বা পাত্রপাত্রীকে অবশ্যই ইতিহাসাশ্রয়ী হতে হবে। তারা কেউ আপন কীর্তির বলে কীর্তিমান,আবার কেউ করুণ। এসব চরিত্রের রূপায়নে ঔপন্যাসিককে ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে।
4.  ইতিহাস ও সাহিত্যে যেহেতু ভিন্ন আঙ্গিক, অবশ্যই শিল্পগত প্রয়োজন বা মূল্যের তাগিদে ঔপন্যাসিক কিছু কিছু উদ্ভাবন বা পরিবর্তন করতে পারেন।
5.  ঐতিহাসিক উপন্যাস গড়ে ওঠে ইতিহাসের বিশাল পটভূমিতে আবর্তিত জীবনের উত্থান পতন নিয়ে। ইতিহাসে সামাজিক, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, আবেগ ও আলোড়ন ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রধান অবলম্বন।
6.  ঐতিহাসিক উপন্যাসে থাকে মহাকাব্যিক বিস্তার; একটি বিশেষ স্থান ও কালের সীমা অতিক্রম করে উপন্যাস পায় বিশ্বজনীন একটা ব্যাপ্তি।
7. ঐতিহাসিক উপন্যাসের ভাষা ব্যবহৃত হবে মার্জিত ও গম্ভীর্যপূর্ন, যাতে তৎকালীন গাম্ভীর্য বজায় থাকতে পারে। – ঐতিহাসিক উপন্যাসের এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসের মধ্যে বিদ্যমান।

ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে তুঙ্গভদ্রার তীরে উপন‍্যাস :

“শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান গুন ঐতিহাসিক কল্পনা। বহুদূর কালের সামান্য কয়খানা ঘটনার কঙ্কালের মধ্যে তিনি প্রতিভার মন্ত্র বলে প্রাণ সঞ্চার করিতে পারেন।” ( প্রমথনাথ বিশী)

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসটি যেহেতু ঐতিহাসিক উপন্যাসের পর্যায়ে পড়ে, তাই এর কাহিনী মূলত ইতিহাস মূলক। কেবলমাত্র প্রাণের আবেগ‌ই নয়, ইতিহাসের গভীর প্রভাব রয়েছে এই উপন্যাসে। ঐতিহাসিক উপন্যাসের যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য গুলির জন্য ”তুঙ্গভদ্রার তীরে’‌ একটি সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে পরিণত হয়েছে। সেগুলি হল –
কাহিনীর সমন্বয়: উপন্যাস মূলত কাহিনী নির্ভর। কাহিনী বা ঘটনা ছাড়া কোন উপন্যাস সৃষ্টি সম্ভব নয়। ঠিক সেই রীতি অনুযায়ী ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসটির কাহিনী গড়ে উঠেছে বিজয়নগরকে কেন্দ্র করে। আনুমানিক ১৪৩০ সালের বিজয়নগরের  মানুষজনের জীবনযাত্রা, রীতিনীতি, আচার ব্যবহার, পোশাক পরিচ্ছদ প্রভৃতি সকল বিষয়কেই তিনি উপন্যাসে সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরেছেন। ইতিহাস বা অতীত মানেই এসে পড়ে রাজা রানীর কথা, এখানেও রাজা দ্বিতীয় দেবরায়ের সাথে ভট্টারিকা বিদ্যুৎমালার বিবাহ প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। নৌকায় রাজকুমারী বিদ্যুৎমালায় চলেছেন রাজা দ্বিতীয় দেবরায়কে বিবাহ করতে। যেখানে বরপক্ষ আসে বিবাহ করতে সেখানে কন্যা পক্ষ যাচ্ছে এইরকম অদ্ভুত নিয়ম, কারণ ঔপন্যাসিক উপন্যাসে ব্যক্ত করেছেন- “তৎকালে নিজরাজ্য ছাড়িয়া বহুদূরে যাওয়া নিরাপদ ছিল না।” এরপরে অর্জুন বর্মার আবির্ভাব ঘটানো হয়, যাতে করে কাহিনীর মোড় ঘুরে যায়। সেই অর্জুন বর্মার সঙ্গে বিদ্যুৎমালার প্রেম যা তৎকালীন সমাজে একটা অপরাধ। এতে রাজাও ক্ষিপ্ত হবে এটাই বাস্তব। অবশেষে নানা কাহিনী সমন্বয়ে তাদের বিবাহের মাধ্যমে মিলন ঘটানো হল।
উপকাহিনী: ‌উপকাহিনি হল উপন্যাসের এমন একটি অ‍ংশ যা উপন্যাসের পাশেপাশে চালিত হয়ে উপন্যাসকে আরো সমৃদ্ধ করে তোলে। উপন্যাসের উপকাহিনির ব্যবহার বহুল প্রচলিত ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের সময় থেকেই। বঙ্কিমচন্দ্রের চন্দ্রশেখর, কপালকুণ্ডলা, দুর্গেশনন্দিনী প্রভৃতি ঐতিহাসিক উপন্যাসে উপকাহিনীর ব্যবহার দেখা যায়। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁর উপন্যাস সৃষ্টিতে বঙ্কিমচন্দ্রের রীতি অনুসরণ করেছিলেন। তার সাপেক্ষে যথেষ্ঠ প্রমান পাওয়া যায় – “ঐতিহাসিক গল্প লেখার প্রেরণা পাই বঙ্কিমচন্দ্র পড়ে। বঙ্কিমচন্দ্রের কাছ থেকেই শিখেছি ভাষার মধ্যে বাতাবরণ সৃষ্টি করা যায় – বিশেষ করে ঐতিহাসিক বাতাবরন।” (শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়; জীবনকথা)
এই উপন্যাসেও উপকাহিনী গড়ে উঠেছে বলরাম ও পিঙ্গলার উপকাহিনী, মন্দদরী ও চিপিটকের উপকাহিনী। এছাড়াও আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপন্যাসটির সমাপ্তি ঘটেছে উপকাহিনীর মধ্যে দিয়েই।
চরিত্রায়ন:  চরিত্র হল উপন্যাসের প্রাণবায়ু। চরিত্রকে বাদ দিয়ে কোন উপন্যাসের কাহিনী সুগঠিত নয়। ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ যেহেতু ঐতিহাসিক উপন্যাস তাই এখানে চরিত্রগুলিকে তুলে আনা হয়েছে ইতিহাসের আঙ্গিকে। মূলত ঐতিহাসিক চরিত্র বিজয়রায়, দ্বিতীয় দেবরায় প্রমুখকে কেন্দ্র করে ঘটনা আবর্তিত হয়েছে। আর একে পুষ্ট করেছে ঐতিহাসিক আবহে বিদ‍্যুন্মালা, মণিকঙ্কনা, অর্জুনবর্মা, কুমার কম্পনের মতো কাল্পনিক চরিত্রগুলি। এই চরিত্র গুলির মাধ্যমে যেমন সৎ চরিত্র পাওয়া তেমনি অসৎ চরিত্র পাওয়া যায়। সৎ ও অসৎ চরিত্র মিলে মিশে একটি উপন্যাসের কাহিনী গড়ে তোলে। এই সমস্ত চরিত্ররা হয় মহিমান্বিত। চরিত্রের পাশাপাশি দৈহিক বর্ণনা তাদের চরিত্রকে আরো সুস্পষ্ট করে তোলে, যেমন বিদ্যুৎমালার দৈহিক বর্ণনা দিতে গিয়ে তার চরিত্রকেই যেন সুপ্রস্ফুটিত করে তুলেছেন –“নিবিড় কালো চোখ দুটি শান্ত অপ্রগলভ, সর্বাঙ্গের উচ্ছলিত যৌবন যেন চোখ দুটিতে আসিয়া স্থির নিস্তরঙ্গ হইয়া গিয়াছে। তাঁহার প্রকৃতিতেও একটি মধুর ভাবমন্থর গভীরতা আছে যাহা সহজে বিচলিত হয় না। অন্তঃসলিলা প্রকৃতি…।”  আবার অপরদিকে মণিকঙ্কনার প্রসঙ্গে বলেছেন- “চঞ্চল চক্ষু দুইটি খঞ্জনা পাখির মতো সঞ্চারনশীল, অধর নবকিশলয়ের মতো রক্তিম।…পৃথিবীটা তাহার রঙ্গ কৌতুকের খেলাধুলার লীলাঙ্গন।” এছাড়াও উপন্যাসের নানা চরিত্রের সমহার দেখা যায়। পুরুষ চরিত্র গুলি হল- রাজা দ্বিতীয় দেবরায়, অর্জুন বর্মা, বলরাম কর্মকার, রসরাজ বৈদ্য, চিপিটক, কুমার কম্পনদেব এবং নারীচরিত্র গুলি হল- বিদ্যুৎমালা, মনিকঙ্কনা, মন্দদরী, পিঙ্গলা প্রভৃতি।
রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব:  ঐতিহাসিক উপন্যাসে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আরেকটি বৈশিষ্ট্য। ইতিহাসে রাজায় রাজায় যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব তো আছেই, এই উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল নবাবী আমলের মুসলমান সাম্রাজ্যের শাসন। তাদের শোষণ, পীড়ন, অত্যাচারের কথা ঔপন্যাসিক উপন্যাসের কাহিনীর মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন- “সেসময়ে গুণী ও কর্মকুশল হিন্দু পাইলেই মুসলমান রাজারা তাহাদের বলপূর্বক মুসলমান করিয়া নিজেদের কাজে লাগাইতেন।” তাদের অত্যাচার এত চরমে উঠেছিল যে নারী স্বাধীনতা ও হিন্দু সমাজ পরিত্রান পেতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা যায় বলরামের কথায় –“ওরা বড় অত্যাচারী,বর্বর জাত। আমিও ওদের জন্য দেশ ছেড়েছি।” এই এক‌ই পরিস্থিতির শিকার হয়েছে অর্জুন বর্মাও। কাহিনীতে দেখা যায় বলরামের সুন্দরী  স্ত্রীকে মুসলমানরা অপহরণ করে এবং উপন্যাসে  মুসলমানদের সঙ্গে রাজা দ্বিতীয় দেবরায়ের যুদ্ধের প্রসঙ্গ‌ও পাওয়া যায়।
সামাজিক দ্বন্দ্ব: উপন্যাসে সামাজিক দ্বন্দ্ব থাকবে না একথা প্রায় অসম্ভব। ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসেও তৎকালীন সামাজিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। সেযুগে এক রাজার অনেক রানী তো থাকতই, তৎকালীন সময়ে আর্যরা এসে এক রীতি প্রচলন করেছিল – “বিবাহের যিনি পর তিনি ইচ্ছা করিলে বধুর তাহাদের অনূঢ়া ভগিনীদের গ্রহণ করতে পারতেন।” এছাড়াও তৎকালীন সমাজ আরেক প্রকার প্রথা ছিল “মাতুলের সহিত ভগিনেয়ীর বিবাহের পর স্পৃহনীয় ও বঞ্চিত বিবাহ।” –  এছাড়া উপন্যাসে দেখা যায় তৎকালীন ভৌগোলিক চিত্র,তুঙ্গভদ্রার বিবরণ, বিজয়নগরের ইতিহাস, তৎকালীন জলপথে যাতায়াতের পদ্ধতি ইত্যাদি। কাহিনীতে যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব ছাড়াও প্রেম ও ভালোবাসা আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। সব দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়  ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ একটি সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস।

লেখকের শিল্পনৈপুণ্য:

“আমার কাহিনী fictionised history নয় historical fiction”. (শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়; তুঙ্গভদ্রার তীরে ভূমিকা)

     ভারতীয় ইতিহাসের প্রতি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল প্রবল অনুরাগ আর সেই ভারতাত্মাকে তিনি খুঁজে চলেছেন ঐতিহাসিক গল্প বা উপন্যাস, এক্ষেত্রে তাকে বঙ্কিমচন্দ্রের উত্তরসূরী বলা যেতেই পারে। কিন্তু শরদিন্দু যে এক ভিন্ন ধরনের ইতিহাস মন্থন করেছেন তা আমাদের নজর এড়ায় না –

“আপনার সকল রচনার মধ্যেই একটা বৈশিষ্ট্য দেখতে পায় যা আর কারো লেখাই নেই।  বর্ণনার মাঝে মাঝে আপনার সরস Obeter dictum – সেখানে পাঠককে থেকে থেকে উপভোগ করতে হয়, যেমন পোলাও খেতে খেতে, পোস্তা বাদাম মেলে।” (রাজশেখর বসু)

বঙ্কিমের সাহিত্যে যেমন বিশাল পাথরের স্থাপত্য আর অন্যদিকে শরদিন্দু সৃষ্টি যেন মন্দির গাত্রের প্রাচীন অলংকরন। এক কথায়, বঙ্কিম যদি মেঘের গর্জন হয় তাহলে শরদিন্দু বীনার ঝংকার। ঐতিহাসিক কাহিনী গুলোই মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের উষ্ণতা যেমন রয়েছে, তেমনি এসেছে রাষ্ট্রনীতির টানা পোড়েন, অর্থনৈতিক সংকট।

শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে – “শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পূর্ণ উপন্যাস ও ছোট গল্প সংগ্রহ উভয়বিধ রচনাই প্রচুর নিদর্শন দিয়েছেন। তাঁহার উপন্যাসগুলি সুলিখিত।… কিন্তু ইহাদের মধ্যে কোন গভীর ও অন্তর্ভেদী ভেদে জীবন পরিচয়ের বিশেষ নিদর্শন মেলেনা।” 


ইতিহাস পিপাসু মন আর জ্ঞান দুইয়ের মিলিত ফসল, ইতিহাসকে উপন্যাসের আকারে পাতায় সাজিয়ে ফেলা।

সুকুমার সেন এই প্রসঙ্গে বলেন যে- “দূরের দৃশ্যপটকে কাছাকাছি নিয়ে এসে দুরের মানুষকে কাছের মানুষ করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন শরদিন্দুবাবু।” 

এখানেই তিনি ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখক রূপে বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী।