ছোটগল্পকার বনফুল

কলমে – শ্রেয়সী মিশ্র, এম.এ(বাংলা), মেদিনীপুর কলেজ




    বাংলা সাহিত্য পাঠকের চোখে বনফুল যাঁর ব্যক্তিগত নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় আজও এক বিস্ময় ও অনপনেয় রহস্য। তাঁর সৃষ্টিতে বিস্ময়ের দিকটি সার্থক ব্যাখ্যাত হয়েছে ড. শ্রী কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিচার দৃষ্টিতে  –

” বনফুলের রচনায় পরিকল্পনার মৌলিকতা ,আখ্যানবস্তু সমাবেশে বিচিত্র উদ্ভাবনী শক্তি , তীক্ষ্ণ মনোনশীলতা ও নানারূপ পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে  মানব চরিত্রের যাচাই পাঠকের বিস্ময় উৎপাদন করে “।

কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত বনফুল বাস্তব জীবন ও জ্ঞান- বিজ্ঞানের বিচিত্র উপাদান তাঁর গল্প ও উপন্যাসে নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ‌। কবিতা, উপন্যাস, ছোটোগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ইত্যাদি সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অনায়াস বিচরন দেখে মনে হয় , ‘Here is God’s plenty’। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি যথআর্থই সব্যসাচী লেখক। বনফুলের লেখা ছোটোগল্প গুলোকে বাংলা সাহিত্যে এক অপরূপ বিস্ময় বলে মনে করা যায়। বাংলা সাহিত্যের জগতে এক বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হলেন বনফুল অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়।

জন্ম ও বংশ পরিচয় :-
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় প্রধানত বিহারবাসী বাঙালি লেখক। ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৯ শেষ জুলাই বিহারের পূর্নিয়া জেলার বর্তমানে কাটিহার জেলার মনিহারী গ্ৰামে তাঁর জন্ম। তাঁদের পরিবার কাঁটাবুনে মুখুজ্জ্যে’ নামে পরিচিত ছিল।পিতা সত্যচরন মুখোপাধ্যায় ছিলেন মনিহারীর প্রসিদ্ধ ডাক্তার ও মাতা মৃণালিনী দেবী ছিলেন গৃহবধূ। ছয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে বলাইচাঁদ জ্যেষ্ঠ। তিনি নিজে এবং তাঁর ওপর তিন ভাইয়ের ও ডাক্তারী পেশাতেই স্বীকৃতি লাভ। বলাইচাঁদের অনুজ অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ছিলেন খ্যাতনামা চিত্রপরিচালক। তাঁর পিতা মনিহারী গ্ৰামে দাতব্য চিকিৎসালয় এবং মাইনর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। অন্যান্য বহু জনহিতকর কাজে, বহু লোকের সঙ্গে সংযোগ সম্পর্কে আদর্শবাদী পিতার প্রভাব বলাইচাঁদের উপর দেখা যায়। অতিথি পরিজনে পূর্ণ, ঝি – চাকর পরিবৃত, জাতি- ধর্ম- বর্ণহীন, আভিজাত্যের অহঙ্কার শূন্য পারিবারিক পরিবেশে বনফুলের শৈশব ও কৈশোর জীবনযাপন। হিন্দু – মুসলিম অসংখ্য সহচর বন্ধুর সান্নিধ্য লাভ।

শিক্ষা ও কর্মজীবন :-
প্রথমে মনিহারী স্কুলে এবং পরে সাহেবগঞ্জ জেলার  সাহেবগঞ্জ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে তিনি লেখাপড়া করেন। শেষোক্ত স্কুল থেকে ১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি আই.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন  হাজারিবাগ সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে। কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে  চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন তবে পাটনা মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি ডিগ্ৰি লাভ করেন।প্যাথলজিস্ট হিসেবে ৪০ বৎসর কাজ করেছেন। ১৯৬৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে স্থায়ী ভাবে কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করেন।
               বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় কৈশোর বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। নিজের ব্যাখ্যায় সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “ছেলেবেলায় ভৃত্য মহলে আমার নাম ছিল জংলি বাবু। বনজঙ্গল আমি খুব ভালোবাসি। বাল্যকালে অনেক কীটপতঙ্গ ও প্রজাপতির পেছনে ঘুরিয়াছি। পরিনত বয়সে ও পাখি চিনিবার জন্য অনেক জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরিতে হইয়াছে। বধ চিরকালই আমার নিকট রহস্য নিকেতন এইজন্যই বোধ হয় ছদ্মনাম নির্বাচনের সময় ‘বনফুল’ নামটি আমি ঠিক করিলাম”। প্রধানত কবিতা লেখার জন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে নিজের নাম লুকোতে তিনি বনফুল ছদ্মনামের আশ্রয় নেন। ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দে সাহেবগঞ্জ স্কুলে পড়ার সময় মালঞ্চ পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার সাহিত্যিক জীবনের প্রকাশ ঘটে। শনিবারের চিঠিতে ব্যঙ্গ কবিতা ও প্যারডি কবিতা লিখে  সাহিত্য জগতে নিজের আসন স্থায়ী করেন। এছাড়াও নিয়মিত প্রবাসী,ভারতী এবং সমসাময়িক অনেক পত্রিকায়  ছোটো গল্প প্রকাশ করেন‌।

বনফুলের সাহিত্য জীবন :-
বনফুলের সাহিত্য মানস বহুধা বিস্তৃত। মনিহারী তে থাকাকালীন কিশোর বয়সেই সাহিত্য বোধের সঞ্চার। পিতার আনুকূল্যে শেক্সপীয়রের গল্প, নবীন সেন ও রবীন্দ্রনাথের কবিতা, এবং বান্ধব- সুপ্রভাত – প্রদীপ-প্রবাসী-বসুমতী-হিতবাদী ইত্যাদি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠ করতেন। উৎসাহিত হয়ে হাতে লেখা পত্রিকা ‘বিকাশ’ প্রকাশ। তারপর পরিণত বয়সে পরিমল গোস্বামীর অনুরোধে শনিবারের চিঠিতে ব্যঙ্গ রচনা কবিতাকারে লেখেন। কিন্তু কবিতা নয় ‘বিচিত্রাচারী’ বনফুলের স্বক্ষেত্র হয়ে ওঠে প্রধানত কথাসাহিত্য। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক বনফুলের গল্পগ্ৰন্থ গুলো হল –
‘বনফুলের গল্প'(১৯৩৬),‌ ‘বনফুলের আরও গল্প'(১৯৩৮),  ‘বাহুল্য'(১৯৪৩),’বিন্দু বিসর্গ'(১৯৪৪), ‘অদৃশ্যলোক'(১৯৪৬),’আরোও কয়েকটি'(১৯৪৭)’ত্বণী'(১৯৪৯), ‘নবমঞ্জরী'(১৯৫৪), ‘ঊর্মিমালা'(১৯৫৫), ‘অনুগামিনী'(১৯৫৮), ‘রঙ্গনা'(১৯৫৬), ‘করবী'(১৯৫৮), ‘সপ্তমী'(১৯৬০), ‘ মণিহারী'(১৯৬৩), ‘ছিটমহল'(১৯৬৩), ‘এক ঝাঁক খঞ্জন'(১৯৬৭), ‘বনফুলের নতুন গল্প’ (১৯৭৬), ‘ বহুবর্ন'(১৯৭৬) , ‘বনফুলের শেষ লেখা’, ‘অলঙ্কারপুরী’।
            এছাড়াও তিনি রচনা করেছেন ‘তৃণখন্ড'(১৯৩৫), ‘বৈতরনীর  তীরে'(১৯৩৬), ‘কিছুক্ষন'(১৯৩৭),’মৃগয়া'(১৯৪০) প্রভৃতি উপন্যাস।

বনফুলের সাহিত্যে বিশিষ্টতা :- 
        গল্পকার বনফুলের রচনায় যে স্বাতন্ত্র লক্ষ্য করা যায় –
১) বনফুলের রচনা রীতির মধ্যে ভাষার স্বাতন্ত্র্য ও সম্ভাবনা পরিস্ফুট । তাঁর মধ্যে আদর্শ ভাষা ও বিভাষার লক্ষন আছে।
২) বনফুলের ছোটো গল্পে মানবজীবনের বিচিত্র রূপের প্রকাশ দেখা যায় । জীবন সম্পর্কে তেমন তাঁর কোনো অতীন্দ্রিয় মোহ ছিল না, তেমনি কোনো বিশেষ আদর্শের প্রতি ও তাঁর অকারন অনুরক্তি ছিল না।
৩) বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের রচনায় আছে সুস্থ জীবনের আকাঙ্খা , মূল্যবোধের চেতনা,অন্ধ সংস্কারের বিরুদ্ধে ধিক্কার।
৪) জীবনের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ, তুচ্ছ ও বিরাট সবকিছুর মধ্য থেকে শিল্পের উপাদান সংগ্ৰহের ক্ষমতা তাঁর রচনা কে দিয়েছে বৈচিত্র্য এবং গভীরতা।
          রবীন্দ্রনাথ বনফুলের ছোটো গল্পের প্রশংসা করে বনফুল কে যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে বনফুলের গল্পের অভিনবত্বের তিনটি উপকরণ চোখে পড়ে –
১) বনফুলের রচনায় বিষয়বস্তুর সঞ্চয় ভান্ডার ‘চোখ এড়ানো সামগ্ৰী নিয়ে’ গড়া । বলাবাহুল্য তার দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছতা থেকে আহৃত।
২) তাঁর গঠনশৈলীতে আত্মসংবরনের বিজ্ঞানী জনচিত সন্তর্পণ প্রয়াস।কারন। তিনি ছিলেন মিতবাক্ শিল্পী।
৩) তাঁর বিজ্ঞানী মেজাজে গড়া গল্প গুলো চোখ ভোলায় না , কৌতুহলের কৌতুকে হাততালির উৎসাহে উৎসাহিত করে তোলে।
          বনফুল ছোটো গল্পের শিল্পী। ছোটোগল্প জীবন খন্ডের রূপায়ন। যে জীবনখন্ড পথে- ঘাটে, হাটে- বাজারে, লোকালয়ে – নির্জনে ছড়িয়ে আছে।

প্রমথনাথ বিশী বলেছেন, “রেলগাড়ি তে স্টেশনে , ওয়েটিং রুমের আড্ডায় , বাসরঘরে, উৎসবে,ব্যসনে, শ্মশানে নিরন্তর যে জীবনতরঙ্গ উঠিতেছে পড়িতেছে তিনি সুনিপুণ কলমে তাহার ছবি আঁকিয়াছেন, কোথাও মন্তব্য করেন নাই”।

এই মন্তব্যের প্রমান পাওয়া যায় ‘এক ফোঁটা’ গল্পটিতে। গল্পকার বনফুলের বিস্ময়কর ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায় তার অতিলৌকিক গল্পগুলিতে, যেমন ‘অধরা’ গল্পটিতে। বনফুলের শিল্পসামর্থ্য কেবল কেবল সাধারন মানুষ বা পরিচিত জীবনের স্বরূপ ফুটিয়ে তোলা নয়,ব্যঙ্গের দর্পনে নির্মম সত্যের উন্মোচনে ব্যপৃত, এই শ্রেণীর গল্প হল ‘পরিবর্তন’।

পুরস্কার ও সম্মান :- 
বনফুল সাহিত্য কর্মের জন্য তিনি ১৯৭৫ খ্রীষ্টাব্দে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ‘শরৎস্মৃতি পুরস্কার'(১৯৫১), ‘রবীন্দ্র পুরস্কার'(১৯৬২), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিনী (১৯৬৭)পদক পান। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডিলিট উপাধি প্রদান করে ১৯৭৩ সালে।

       তাঁর প্রতিভার ছোঁয়ায় জীবনের ছোটোখাটো দিকগুলো মুক্তার মতো নিটোল ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পেশায় চিকিৎসক হলেও নেশায় তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যিক। যাঁর ছোঁয়ায় সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন স্বাদের গল্প। ছোটোগল্পকার হিসেবে বনফুলের অবদান কতখানি তা আর বলার অবকাশ রাখে না।