গণদেবতা উপন্যাসের সমাজজীবন
কলমে – নম্রতা বিশ্বাস, এম.এ, বি.এড
মানবতার স্বার্থে মানুষের কল্যাণের হেতু কিছু মানুষ সর্বদা তৎপর থাকেন, নিজেদের সকল আশা – আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে তাঁরা সমাজকে বাঁচানোর জন্য কাজ করে যায়। সেইসকল মহৎ হৃদয়মানবদের জন্যই আজও হয়তো পৃথিবীর কোনো এক অজপাড়াগাঁয়ে সকাল হলে কৃষকেরা নতুন ধানের মিষ্টি ঘ্রাণে হেসে ওঠে। এই রকমই এক আবহমান বাংলার এক প্রাচীন রীতিতে চলমান গ্রাম্য চিত্র ফুটে উঠেছে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে ভূষিত “গণদেবতা” উপন্যাসটি।
বাংলার মানুষের জাগরণ ও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়ে উদবেগ প্রকাশ করে যাওয়া এক ঔপন্যাসিক হলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এই উপন্যাসে তিনি এক প্রত্যন্ত গ্রামের কথা বলেছেন যার নাম শিবকালিপুর। সেখানে অশিক্ষা, ধর্মীয় গোঁড়ামির কুসংস্কার জর্জরিত একদল মানুষ যারা জমিদারি ব্যবস্থায় শোষিত হওয়াকেই নিজেদের ভবিতব্য ধরে নিয়ে বেঁচে রয়েছে কালের প্রবাহে। এই রকম একটি পরিস্থিতির মধ্যেই আবার ইংরেজদের অত্যাচারের নিদর্শনও লক্ষ করা যায় উক্ত উপন্যাসে।
● কৃষিভিত্তিক সমাজ:- উপন্যাসের প্রথমেই লক্ষ করা যায় গ্রামের সকলেই চাষ বাসের সঙ্গে যুক্ত – “ এখান চাষ শেষ হইয়া আসিল। মাঠে ফসল পাকিয়া উঠিয়াছে।”
অর্থাৎ বলা যেতেই পারে গ্রামের মানুষেরা এই কৃষিকাজের উপর ভিত্তি করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
● কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রাম:– গ্রাম বাংলার মানুষের মধ্যে একধরনের কুসংস্কার বোধ কাজ করে, ঔপন্যাসিক সূক্ষ্ম ভাবে সেটি উপন্যাসের মধ্যে তুলে ধরেছেন । উপন্যাসে দেখা যায় পদ্ম পরবর্তীতে মূর্ছা রোগের স্বীকার হয়েছিল জগন ডাক্তারের কথায় তাঁর মৃগী রোগ হলেও হাসপাতালের ডাক্তারের মতে তাঁর ‘হিসটিরিয়া’ হয়েছে। কিন্তু উপন্যাসে দেখা যায় অনিরুদ্ধের মতে শ্রীহরি কোনো ‘তুক্’ করেছে পদ্মের উপর। –
“কিন্তু অনিরুদ্ধ ও কথা গ্রাহ্য করিল না। তাহার মত কাহার ও সহিত মেলে না। তাহার ধারণা দুষ্ট লোকে তুক্ করিয়া এমন করিয়াছে।”
গ্রামের ডাক্তার জগনকেও দেখা যায় যে তিনিও এই কুসংস্কার বিশ্বাস করতেন-
“জগন ডাক্তার হইলেও প্রাচীন সংস্কার একেবারে ভুলিতে পারে না। রোগীকে মকরধ্বজ এবং ইনজেকশন দিয়াও সে দেবতার পাদোদকের উপর ভরসা রাখে।”
ফলে শিবকালিপুরের মানুষেরা যে কতটা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন এর থেকেই তা প্রমাণিত হয় ।
● বিভিন্ন মানবজাতির সমাবেশ:- উক্ত উপন্যাসে সবরকম শ্রেণির মানুষের কথা পাওয়া যায় যেমন উচ্চ শ্রেণির মানুষদের কথা আছে –
“ চৌধুরীদের সমৃদ্ধি অনেক দিনের কথা। দ্বারকা চৌধুরীর এক পুরুষ পূর্বে তাহাদের বংশ সম্মান সমৃদ্ধির ভান্ডার নিঃশেষিত হইয়াছে।”
উপন্যাসটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় দ্বারকা চৌধুরীর কাল অবসান হওয়ার পাশাপাশি ছিরু পালের উত্থান শুরু হয়েছিল –
“ ছিরু বা শ্রীহরি পালই এই দুইখানা গ্রামের নতুন সম্পদশালী ব্যক্তি।”
অর্থাৎ, বলা যেতেই পারে তৎকালীন সময়ের জমিদারতন্ত্রের অবসান এবং ধনতান্ত্রিক সমাজের যে উত্থান, লেখক সেই বিষয়টিকে আলোচ্য উপন্যাসটিতে তুলে ধরেছেন।
এছাড়া বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের কথাও আলোচ্য উপন্যাসে লক্ষ করা যায়-
“ অনিরুদ্ধ ও গিরিশের সঙ্গে আর একজন আছে, পাতু মুচি । ….. ”
● শাসকদলের সঙ্গে প্রজার সম্পর্ক :- শাসকদের, শোষিত শ্রেণির উপর যে জুলুম, তা উক্ত উপন্যাসের পরতে পরতে লক্ষ করা যায়। আর এই শাসকদের ভূমিকায় যে অবস্থিত সে হলো শ্রীহরি পাল। – “ গোটা পাড়াটা পোড়াইয়া দিবার অভিপ্রায় শ্রীহরির ছিল না। কিন্তু যখন পুড়িয়া গেলই, তখন তাহাতেও বিশেষ আফসোস তাহার হইল না। পুড়িয়াছে বেশ হইয়াছে, মধ্যে মধ্যে এমন ধারার বিপর্যয় ঘটিলে তবে ছোটলোকদের দল সায়েস্তা থাকে ক্রমশঃ বেটাদের আস্পর্ধা বাড়িয়া চলিতেছিল।”
পরবর্তীতে দেখা যায় ছিরু পাল তাঁর টাকার জোড়ে জমিদারের গোমস্তা হিসেবে পরিগণিত হয়। শ্রীহরির চরিত্রে কিছু ভালো দিকও লক্ষ করা যায় যেমন চণ্ডীমণ্ডপকে বাঁধিয়ে দিয়েছিল, তেমনি হরিজন পল্লীর সকলের বাড়ি তাঁর জন্য পুঁড়ে গেলে সে পাঁচ সের চাল ও দশ গণ্ডা করে খড় সকলকে দিয়েছিল –
“পাঁচ সের করে আজ ঘর পিছু আমি দেব।”
কিন্তু তাঁর কিছু ভালো দিক উপন্যাসে দেখা দিলেও তাঁর অত্যাচারের রূপ উপন্যাসে সর্বদা স্পষ্ট করে লেখক দেখিয়েছেন – “মুহূর্তে শ্রীহরি ভীষণ হইয়া উঠিল। হিংস্র ক্রুদ্ধ গর্জনে সে এক হাঁক মারিয়া উঠিল – বোস্! রাখ তালপাতা!”
● সমাজবন্ধু ব্যক্তিবর্গ:– সমাজে যেমন শাসক ও শোষিত শ্রেণির মানুষেরা বাস করেন তেমন আর এক শ্রেণির মানুষেরা বাস করেন, যাঁরা সবসময় এই শোষিত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সর্বদা তৎপর। এই উপন্যাসে এমন চরিত্রের অনেকে আছে যেমন পণ্ডিত দেবনাথ ঘোষ –
“দেবু তাহার দিকে চাহিয়া একটু মৃদু হাসিল, তারপর পাতুদের বলিল- যে যার এখান থেকে চলে যা। আমার গায়ে হাত না দিয়ে কেউ তোদের ছুঁতে পারবে না।”
জগন ডাক্তার – “এ পাড়ার সকলকে ডাকিয়া ডাক্তার বলিল – সব আপন আপন মনিবের কাছে যা, গিয়ে বল- দুটো করে বাঁশ, দশ গণ্ডা করে খড়, পাঁচ – সাত দিনের মত খোরাকি আমাদের দিতে হবে। আর যা লাগবে – চেয়ে – চিন্তে আমি যোগাড় করছি । ”
হরেন ঘোষালের মধ্যেও দেখা যায় এই গুণাবলি। তাঁকেও গ্রামের মানুষদের সাথে হওয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেখা যায় –
“ঘোষাল বলিল- নো, নেভার। ও তুমি ভুল বলছ, দেবু। গাছের পাতা কাটবার স্বত্ব ওদের আছে। তিন পুরুষ ধরে কেটে আসছে। তিন বছর ঘাট সরলে, পারে কেউ সে ঘাট বন্ধ করতে – না পথ বন্ধ করতে।”
পণ্ডিত দেবনাথ ঘোষ বা দেবু ঘোষের অবদান সবার থেকে অবশ্য একটু বেশিই ছিল, তাঁর শক্তিশালী অবস্থান তাঁকে বাকিদের থেকে এগিয়ে রেখেছে বলা যায়।
উপন্যাসের কিছু দূর গিয়ে দেখা যায় জমি জরিপকারী সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে দেবু ঘোষের বিবাদের জেরে দেবু ঘোষের কারাবরণ করতে হয়েছিল পনেরো মাসের জন্য । গ্রামের অনেকেই দেবু ঘোষকে বলেছিল বিবাদ মিটিয়ে নিতে কিন্তু তিনি শোনেন নি কারো কথা এবং কোনো ভুল না করেও কারা বরণ করেছিলেন এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই পরবর্তীতে দেখা যায় সরকারি কর্মচারীরা আগে যেমন গ্রামের মানুষদের সাথে খারাপ আচরণ করত পরবর্তীতে তাঁরা আর সেই আচরণ করতো না – “ বুঝলে খুড়ো, শেষটা আমিন, কানুনগো ‘আপনি’ ছাড়া কথা বলত না । আমরা তোমার নাম করতাম। এইবার হবে তিনধারা, তারপর পাঁচধারা।”
এইসব কিছুই সম্ভব হয়েছে দেবু ঘোষের জন্য।
দেবনাথ ঘোষ সর্বদা তাঁর গ্রামের মানুষদের জন্য তৎপর ছিলেন ফলে গ্রামে যখন কলেরা দেখা দিল এবং মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কেউ ছিল না, তখন তিনি সবাইকে সাহায্য করেছিলেন – “ দেবু ঘোষ নবরূপে পল্লীর এই শৃঙ্খলাহীন যুগে ভাঙাগড়া আসরের মধ্যে – শ্রীহরি পাল, কঙ্কনার বাবু থানার জমাদার, দারোগার রক্তচক্ষুকে তুচ্ছ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে, মহামারীর আক্রমণকে সে রোধ করিয়াছে।”
তৎকালীন সময়ে যেমন ধনতন্ত্রের উত্থান ঘটেছিল তেমনি এমন কিছু মানুষদেরও উত্থান ঘটেছিল যারা সাধারণের জন্য সর্বদা তৎপর থাকতেন। ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে দেখা যায় একদিকে যেমন শ্রীহরি ঘোষের একটি দল অন্যদিকে ‘প্রজা সমিতি’-এর দল , যেখানের মেম্বার জগন, হরেণ, সতীশ প্রমুখ।
● পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রাধান্য:- উপন্যাসের প্রথমেই দেখা যায় একটি দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে উপন্যাসটি শুরু হয়েছে। যেখানে অনিরুদ্ধ কর্মকার ও গিরিশ সূত্রধর দুইজন গ্রামের মানুষদের দেওয়া কাজগুলো ঠিক ভাবে না করার জন্য গ্রামের লোক একটি সভার আয়োজন করে অনিরুদ্ধ ও গিরিশের বিচার করার জন্য –
“যে অনিরুদ্ধের হাত পার হইয়াছে, সে গিরিশের হাতে দুঃখ ভোগ করিতেছে। শেষ পর্যন্ত গ্রামের লোক এক হইয়া পঞ্চায়েৎ – মজলিস ডাকিয়া বসিল। ”
‘গণদেবতা’ উপন্যাসে এই ‘পঞ্চায়েত’ ব্যবস্থার গুরুত্ব যে অপরিসীম তা বলাই যায়। বিভিন্ন স্থানে এই সভার কথা পাওয়া যায়, উক্ত উপন্যাসে দেখা যায় গ্রামে যে – কোনো কারণেই এই সভার আয়োজন করা হতো-
“আজ চণ্ডীমণ্ডপের মজলিসে দেবনাথই সকলকে সম্ভাষণ জানাইতেছিল, সেই উদ্যোক্তা, মজলিস আরম্ভ হইবার পূর্ব হইতেই আসর সে বেশ জমাইয়া তুলিয়াছে।”
■ গণদেবতা উপন্যাসে চণ্ডীমণ্ডপের গুরুত্ব:- ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে ‘চণ্ডীমণ্ডপ’ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। উক্ত গ্রামে যা কিছুই হোক না কেন তা চণ্ডীমণ্ডপকে ঘিরেই হতো। গ্রামের মানুষদের কাছে এই চণ্ডীমণ্ডপই ছিল যেন প্রথম আবাসস্থল। যদিও চণ্ডীমণ্ডপের মালিক জমিদার কিন্তু আসলে সেটি ছিল জনসাধারণেরই। গ্রামবাসীরাই তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ করত, জনসাধারণই ছিল তার প্রকৃত মালিক – “ ওটা জমিদারের সম্মান। তা ছাড়া শূদ্রের গ্রাম, জমিদার ব্রাহ্মণ, তিনিই সেবায়েত হয়ে আছেন। আর ধরুন, গ্রামের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয়, দলাদলি হয়। এই কারণেই জমিদারকেই দেবোত্তরের মালিক স্বীকার কথা হয়েছে। কিন্তু অধিকার গ্রামের লোকেরই। ”
হেন কোনো কাজ নেই যা চণ্ডীমণ্ডপকে ঘিরে হতো না, উপন্যাসের প্রথমেই দেখা যায় অনিরুদ্ধ ও গিরিশের সঙ্গে গ্রামের লোকের যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রতিকারের জন্য চণ্ডীমণ্ডপেই সভা বসেছিল – “ গ্রামের শিবতলায় বারোয়ারী চণ্ডীমণ্ডপের মধ্যে মজলিস বসিল ।” এরপর উপন্যাসে চণ্ডীমণ্ডপকে কেন্দ্র করে অগনিতবার সভা বসার উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্রামে কোনো ব্যক্তি এলেও এই চণ্ডীমণ্ডপে এসেই আসন গ্রহণ করে থাকে – “ পুলিশ আসিয়া গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপেই বসিয়াছিল।”
এমনকি কোনো পূজা অর্চনা হলে চণ্ডীমণ্ডপেই তা পালিত হতো – “ সন্ধ্যায় চণ্ডীমণ্ডপে মনসার ভাসান গান হইবে । ”
এছাড়া গ্রামে বাচ্চাদের যে পাঠশালা সেটিও চণ্ডীমণ্ডপেই বসে – “ চণ্ডীমণ্ডপেই গ্রাম্য পাঠশালা বসে; পাঠশালার প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন হইতেই চণ্ডীমণ্ডপই পাঠশালার নির্দিষ্ট স্থান। ”
গ্রামের খাজনা আদায়ের যায়গাও এই চণ্ডীমণ্ডপ – “পথে চণ্ডীমণ্ডপ হইতে ডাকিল শ্রীহরি। সেখানেও চারপাশে একটি ছোট – খাটো ভিড় জমিয়া রহিয়াছে। দেবু অনুমানে বুঝিল, খাজনা আদায়ের পর্ব চলিতেছে। ”
এমনকি শ্রীহরি ঘোষও সেখানে বিভিন্ন ধরণের সভা আয়োজন করে থাকে – “ চণ্ডীমণ্ডপ আজ অন্ধকার। ছিরু পাল আজ চণ্ডীমণ্ডপে বসে নাই ।”
শিবকালিপুর গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপ যেন তাদের জীবনের একটি অঙ্গ। একে কেন্দ্র করেই তাঁদের সমস্ত কর্ম হয়ে ওঠে। চণ্ডীমণ্ডপ ছাড়া গ্রামবাসী যেন কিছু ভাবতেই পারেনা। গ্রামের সামাজিক কার্য প্রণালীতে চণ্ডীমণ্ডপের ভূমিকা সর্বপ্রথম তা বলা যায় । এই চণ্ডীমণ্ডপের অবস্থান বহুদিনের, উপন্যাসে দেখা যায় তিরিশ বছর আগে থেকেই এই চণ্ডীমণ্ডপ গ্রামে অবস্থিত, তখন সবরকম সামাজিক কার্য এই চণ্ডীমণ্ডপেই হতো, বিবাহ থেকে শুরু করে ডাক্তার বৈদ্য সকলে এই চণ্ডীমণ্ডপেই বসতো– “ ত্রিশ বৎসর পূর্বেও এই আটচালা ও চণ্ডীমণ্ডপ এমনি ভাবে নিত্য সন্ধ্যায় জমজমাট হইয়া উঠিত। গ্রাম্য-বিচার হইত, সংকীর্তন হইত; পাশা – দাবাও চলিত; গ্রামখানির সলাপরামর্শের কেন্দ্রস্থল ছিল এই চণ্ডীমণ্ডপ ও আটচালা। গ্রামে কাহারও কোন কুটুম্ব সজ্জন আসিলে – এই চণ্ডীমণ্ডপেই বসানো হইত ।”
চণ্ডীমণ্ডপ নির্জীব বস্তু ঠিকই, কিন্তু গ্রামে পুরাতন থেকে নতুন সমাজ ব্যবস্থার যে ধারা বয়ে চলতে দেখা দিয়েছে আলোচ্য উপন্যাসে তার প্রতক্ষ সাক্ষার বহন করে চলেছে এই চণ্ডীমণ্ডপ, সে পুরাতন থেকে নতুন দুইটি ভিন্ন ধারারই প্রতীক বলা যায়।
● উপন্যাসে নারীদের ভূমিকা:– ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে একাধিক নারী চরিত্রের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, এক একজনের এক একধরনের কাহিনী উপন্যাসে উঠে এসেছে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এই সকল নারী চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে সমাজের এক ভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে দেখা যায় এখানে অবস্থিত বেশির ভাগ মানুষই অর্থাভাবে জর্জরিত, ফলে অর্থের জন্য নিজের মা-ও মেয়েকে দিয়ে অপ্রকৃতিস্থ কাজ করাতে দ্বিধা বোধ করেন না, এই চিত্রই ফুটে ওঠে দুর্গা ও তাঁর মায়ের মধ্য দিয়ে –
“সব শুনিয়া মায়ের চোখেই বিচিত্র দৃষ্টি ফুটিয়া উঠিয়াছিল; একটা উজ্জ্বল আলোকিত পথ সহসা যেন তাহার চোখের সম্মুখে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল – সেই পথই সে কন্যাকে দেখাইয়া দিয়া বলিল – যাক্, আর শ্বশুরবাড়ির যেতে হবে না ।”
উপন্যাসের দেখা যায় দুর্গা কারো বউ নয়; সে স্বাধীন, আর স্বাধীন হতে গিয়েই লেখক তাকে স্বৈরিনী হিসেবে দেখিয়েছেন। কিন্তু দুর্গা এখানে শুধু স্বৈরিনী নয়, লেখক তাঁর কিছু ভালো দিকই তুলে ধরেছেন, দেবু ঘোষের যখন জেল হয়েছিল তখন সে বিলু-কে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছিল- “উদায়াস্ত দুর্গা বিলুর কাছে থাকে, দাসীর মত সেবা করে, সাধ্যমত সে বিলুকে কাজ করিতে দেয় না, ছেলেটাকে বুকে করিয়া রাখে।”
এমনকি অনিরুদ্ধদেরও সে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছিল। পরবর্তীতে দেখা যায় অনিরুদ্ধের জমি নিলামে গেলে সে মাতাল ও ভবঘুরে হয়ে যায়, দুর্গা তাকে বিভিন্ন ভাবে টাকা দিয়ে সাহায্য করতো এমনকি যতীনকে রাখার ব্যবস্থা দুর্গাই করে দিয়েছিল –
“দুর্গার যোগাযোগেই দারোগা ডেটিনিউ রাখিবার জন্য অনিরুদ্ধের ঘরখানা ভাড়া লইয়াছে।”
অন্যদিকে, দেবু ঘোষের স্ত্রীর মধ্য দিয়ে লেখক গ্রাম বাংলার সেইসকল বধূদের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন যাঁরা স্বামী সোহাগী হয় – “বিলু লজ্জিত ভাবেই বলিল – দেখ দেখি হয়েছে কিনা। কামার – বউকে শুধিয়ে এলাম, নজরবন্দীর চা কামার – বউ করে কিনা!”
অন্যদিকে অনিরুদ্ধ কর্মকারের বউ পদ্ম সে শক্ত, সমর্থ, সন্তানহীনা, স্বামীর একনিষ্ঠ হিতাকাঙ্খী – “মাছ নহিলে অনিরুদ্ধের ভাত উঠিবে না।”
ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই গ্রামটির সমাজ ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সব রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে গ্রামের মানুষদের। একটি নির্দিষ্ট সামাজিক ব্যাধি নিয়ে নয় বরং অনেকগুলো সামাজিক ব্যাধি ও তার প্রতিকার নিয়ে রচিত হয়েছে আলোচ্য উপন্যাসটি। গ্রাম্য পরিবেশের এক অভূতপূর্ব নিদর্শন হলো এই ‘গণদেবতা’ উপন্যাস। উপন্যাসের বিষয়বস্তুই বিভাগোত্তর ভারতবর্ষ সমাজ ব্যবস্থা এবং স্বাধীনতা আন্দোলন ও শিল্পায়নে পরিপ্রেক্ষিত গ্রামীণ সমাজের বিবর্তন । তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণদেবতা তৎকালীন গ্রাম বাংলা তথা সমগ্র গ্রমীণ ভারতবর্ষের নিপীড়িত মানুষের দর্পনস্বরূপ। সেই সাথে উপন্যাসটি শাসন এবং শোষণের সহস্র বছরের চলমান ধারার দলিল ।