কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ

কলমে : অনন্যা সাহা, বি.এ ( বাংলা ), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়


      বাংলা সাহিত্য জগতে সুবোধ ঘোষের (১৯০৯-১৯৮০) আত্মপ্রকাশ বেশ আকস্মিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়পর্বে সুবোধ ঘোষ বাংলা সাহিত্য জগতে নিজের লেখনীর দ্বারা সার্থক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৪০ সালে তাঁর লেখা ‘ফসিল’ ও ‘অযান্ত্রিক’ রচনা দুটি এক অনন্য ধরণের নবপ্রতিভার বার্তা বহন করে আনে । বিভিন্ন ধরণের বাস্তব ধারণা এবং অভিজ্ঞতারকে ভিত্তি করে লেখক নিজ লেখা গুলিকে গ্রথিত করেন। বলাবাহুল্য তাঁর রচনা গুলির মধ্যে তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট। নিজ কর্মজীবনে তিনি নানার পেশার পাশাপাশি নানান মানুষের সংস্পর্শে আসেন এবং ঠিক সেই কারণেই তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার ঝুলি অতীব বাহুল্যতায় ভরে ওঠে।
আনন্দবাজারের অন্তর্গত কয়েক জন লেখক ‘অনামী সংঘ’ নামে এক সমাবেশ গঠন করেছিলেন। তাঁরা সেই সমাবেশের মাধ্যমে,প্রতি মাসের দুই রবিবার নিজেরদের কোনো এক বন্ধুর বাড়িতে সমবেত হয়ে সাহিত্যের আলোচনা ও নিজের রচনা পাঠ করতেন। এই লেখকদেরই অনুরোধে লেখক প্রথম ছোট গল্প রচনা শুরু করেন। এর আগে ফ্রয়েডিয় মনস্তত্ব নিয়ে একটি মাত্র নিবন্ধ রচনা করেছিলেন। এই ভাবেই শুরু হয় তাঁর সাহিত্য রচনার পথ।

জন্ম ও বংশপরিচয় :
       ১৯০৯ সালের ১৪ ই সেপ্টেম্বর সুবোধ ঘোষ জন্ম গ্রহণ করেন। বাংলা সাহিত্যের মহলে ইনি এক বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাত। তিনি এক নিম্নবৃত্ত কায়স্থ পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর জন্ম স্থান হলো বিহারের হাজারিবাগ এবং তাঁর চার পুরুষের আদিনিবাস ছিল বাংলাদেশের, ঢাকার, বিক্রমপুরের অন্তর্গত বহর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ছিল শ্রী সতীশ চন্দ্র ঘোষ তিনি জেলখানার অধস্তন চাকুরে ছিলেন এবং তাঁর মাতা ছিলেন শ্রীমতি কনকলতা দেবী। পরিবারের সাত সহদরের মধ্যে সুবোধ ঘোষ ছিলেন দ্বিতীয় জাত সন্তান।

শিক্ষা ও কর্মজীবন :
       লেখক সুবোধ ঘোষ ছেলেবেলা থেকেই প্রকৃত শিক্ষার আবেশে বেড়ে ওঠেন। কৈশোর কালে কবি কামিনী রায়ের সান্নিধ্যে আসেন তিনি ও তাঁর কাছ থেকে লেখক ‘গুঞ্জন’ ও ‘অশোক সংগীত’ উপহার পান। ছাত্রজীবনে হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজে তিনি পড়াশোনা করেন। এছাড়া মহেশ ঘোষ নামক এক বিশিষ্ট দার্শনিক এবং গবেষকের লাইব্রেরিতে সুবোধ ঘোষের বিদ্যার্জনের যাত্রা বিশেষ ভাবে গতি লাভ করে।
প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি পুরাতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব,ধর্মতত্ত্ব,নৃতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান,দর্শন, ইতিহাস, জ্যোতিষশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয় নিয়েও বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করে তাঁর কলেজ জীবনের সূত্রপাত হয় তবে অভাব অনটনের কারণে তাঁর পড়াশোনা মাঝ পথে বন্ধ হয়ে যায় এবং সুষ্ঠু জীবিকার তাড়নায় তাঁকে গতানুগতিক কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে হয়।
জেষ্ঠ ভ্রাতা সুধীর ঘোষের উপার্জন পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত না হওয়ায় লেখক কর্ম জীবনে পদার্পন করতে বাধ্য হন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানিক ভাবে তাঁর শিক্ষা জীবনের ইতি ঘটলেও কর্মজীবন তাঁর কাছে আর এক অনন্য শিক্ষার পন্থা উন্মুক্ত করে দেয়। কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার ভান্ডার উৎকৃষ্টতম হতে থাকে।  রমেশচন্দ্রের সাথে মিত্রতার সুবাদে তাঁর সাথে নৃতাত্ত্বিক শরৎচন্দ্র রায়ের সাক্ষাৎ হয় এবং এনার গবেষণা পত্র গুলি পঠনের মাধ্যমেই তিনি ভারতবর্ষের আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবন যাত্রা সম্মন্ধে জ্ঞান লাভ করেন। এছাড়া রায়বাহাদুর পার্বতীলালের কাছে তিনি নদী, সমুদ্র, পাথর, পাহাড়, ফসিলের পুরাণ গাঁথা শ্রবণ করেন।
সুবোধ ঘোষের প্রথম জীবনের চাকরি ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁর প্রথম কাজ ছিল হাজারিবাগের দেহাতি হাসপাতালে মড়ক প্রতিষেধক দেওয়া। টানা ছমাস ধরে বিষম দক্ষতার সাথে কাজ করার পরে তিনি ভীষণ প্রশংসিত হন এবং প্রশংসা পত্রও পান। এর পরে তিনি বাস কনডাক্টার হিসেবে কাজ করা শুরু করেন আবার ট্রাক চালক হিসেবেও কাজ করেন। এছাড়া জীবিকার তাগিদে তিনি সার্কাসের লটবহর টানার কাজও রপ্ত করেন। বিস্তৃত ভাবে বলতে গেলে লেখকের জীবনের বিভিন্ন পেশার কথা আমরা অনায়াসে পাবো। সার্কাসের আসর,ছোটোনাগপুরের বন,সাংবাদিকতা, ওয়াজিরিস্থানের পথ পরিক্রমা,প্রাইভেট টিউশন ইত্যাদি নানান প্রকারের কাজের সাথে লেখক নিজের সারাটা কর্মজীবন অতিবাহিত করেন।

সুবোধ ঘোষের সাহিত্য রচনা  :
       নিজ জীবৎকালে তথা নিজ সাহিত্য জীবনে লেখক সুবোধ ঘোষ নানান ধরণের রচনা করে যান। অন্যান্য বাস্তবিক বিষয় সহ নৃতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান , ইতিহাস  সম্মন্ধিয় পুস্তিকাও লেখকের অত্যাবধানে অতীব স্বকীয়তার সাথে প্রকাশ পেতে লক্ষ্য করা যায়। তিনি নিজ চিন্তন উদ্ভুত বিভিন্ন বিষয়কে ছোটগল্প , উপন্যাস জাতীয় সাহিত্য প্রকরণের মাধ্যমে আমাদের কাছে তুলে ধরেন।
লেখক মহাশয় ১৯৪০ থেকে ১৯৬৮ সালের সময়পর্বে ১৫৭ টি গল্প লেখেন। এছাড়া  ৩০ টি উপন্যাসের পাশাপাশি কিছু নাটক, প্রবন্ধ ও রম্যরচনাও তাঁর রচনা তালিকার অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রসঙ্গত সুবোধ ঘোষ রচিত প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে। বলাবাহুল্য ১৯৪০ সাল থেকেই তাঁর প্রকৃত সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত সূচিত হয় ।
তাঁর রচিত কিছু ছোট গল্প হলো অযান্ত্রিক (১৯৪০),ফসিল (১৯৪০)পরশু রামের কুঠার (১৯৪০), গ্রাম যমুনা (১৯৪৪),কুসুমেসু (১৯৫৬),মনোবাসিতা (১৯৫৭), পলাশের নেশা (১৯৫৭), নিত সিঁদুর (১৯৫৮),জতুগৃহ (১৯৬২), নিকষিত হেম (১৯৬৩),রূপ নগর (১৯৬৪) ইত্যাদি।
এছাড়া  তিলাঞ্জলি (১৯৪৪),গঙ্গোত্রী (১৯৪৭), ত্রিযামা (১৯৫০), ভালোবাসার গল্প (১৯৫৮), শতকিয়া (১৯৫৮) ইত্যাদি তাঁর লিখিত বিশেষ উল্লেখ্য উপন্যাস ।

সুবোধ ঘোষের সাহিত‍্য রচনার বিশিষ্টতা :
       সুবোধ ঘোষের লেখাগুলিকে বিশদে বিশ্লেষণ করলে তাঁর রচনাশৈলীর কিছু বিশিষ্টতা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। নিম্নে তাঁর কিছু লেখাকে অবলম্বন করে এই বিশিষ্টতা গুলিকে তুলে ধরা হলো –

১. লেখক সুবোধ ঘোষের মধ্যে ছিল আধুনিকসত্তা এবং তার পাশাপাশি সমাজ বিজ্ঞানী সুলভ দৃষ্টিভঙ্গি তবে এই এসবের সাথে তাঁর মধ্যে ছিল পূর্বসুরীদের ঐতিহ্য এবং তাঁদের গ্রহণযোগ্য গুণাবলী, যার প্রকাশ তাঁর লেখনীর মধ্যে স্পষ্ট।

২. তিনি জাতির জীবনের ব্যাপ্তির মধ্যে , জীবনের এক নব রূপকে অনুধাবন করেন। এবং এই জীবন রহস্যকে তিনি নিজ শিল্পকর্মের মধ্যে যথাযথ ভাবে আত্মসাৎ করেন।

৩. বাংলা সাহিত্যের ব্যাপ্তির জন্য তিনি মূল পন্থা হিসেবে কখনোই বিদেশী সাহিত্যের অনুকরণকে বেছে নেননি।

৪. তাঁর লেখা পঠন করলে জাতির জীবনের সৌন্দর্যতা এবং রম্যতায় প্রকাশিত হয় ।

৫. সময়ের সাপেক্ষে তাঁর নিজ মননের বিচিত্রতা, স্বচ্ছতা এবং সতেজতা তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি লেখায় আত্মপ্রকাশ করেছে বাঁধাহীন ভাবে।

৬.তাঁর লিখিত ফসিল গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় অগ্রণী প্রত্রিকায় এই গল্পে তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনার কথা বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও এর মধ্যে তাঁর অঞ্চলভিত্তিক অভিজ্ঞতা লব্ধ জীবন দর্শন স্পষ্ট। আগ্রাসন, নির্যাতন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, সাধারণের মুক্তির আকাঙ্খা এ সবই এই গল্পের প্রাণকেন্দ্র। ফলত আমরা বলতে পারি লেখকের, লেখন পদ্ধতিতে,জীবনবোধ বিশেষ ভাবে কার্যকরী।

৭. তাঁর লেখার বিষয় নির্বাচন ছিল অনন্য এর দৃষ্টান্ত আমরা অযান্ত্রিক গল্পের পটভূমির মাধ্যমে পায়। এখানে একটি গাড়ির সাথে, এক মানুষের অদ্ভুত মানবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার কাহিনী বর্ণিত হয়, যে কাহিনী তৎকালীন সময়ে বাঙালি পাঠক সমাজের কাছে ছিল বিশেষ আকস্মিক।

৮. মধ্যবিত্ত মানুষের কথাও তাঁর গল্পের বিষয় বস্তু থেকে বাদ পরেনি। মধ্যবিত্তদের ভীরুতা, নিচতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, ভণ্ডামি এবং নিজ সুবিধাকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতাকে লেখক তুলে ধরেন গোত্রান্তর গল্পে।

৯. তাঁর রচনার মধ্যে রাজনৈতিক পটভূমিও বিরল নয় , তিলাঞ্জলি উপন্যাসে তিনি নিজ রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করেন। কংগ্রেসের সাহিত্য সংঘের মতাদর্শ এখানে প্রতিফলিত হতে লক্ষ্য করা যায়।

পুরস্কার ও সম্মান :
      নানান ধরণের সাহিত্যিক কর্মের মাধ্যমে সুবোধ ঘোষ বাংলা সাহিত্য জগতে নিজস্ব এক স্বতন্ত্র জায়গা সৃষ্টি করেন। যে জায়গায় তাঁকে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে তাঁর রচিত, সাহিত্য কীর্তিগুলি। নিজ পূর্ব লব্ধ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে তিনি নিজের রচনাগুলির আখ্যানভাগ বুনন করেন,যে আখ্যান গুলি সাধারণের কাছে বাস্তব জীবনের বার্তাই বহন করে আনে এবং এই কারণেই পাঠকবর্গ তাঁর লেখার প্রতি বিশেষ আবেগ প্রদর্শন করে। ফলে বাংলা সাহিত্যে সুবোধ ঘোষের সম্মান দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাঁর লেখার জোড়ে তিনি এই ভাবেই বিভিন্ন স্থানে নানা ধরণের সম্মাননা লাভ করেন যে সম্মাননা গুলির মধ্যে অন্যতম হলো আনন্দ বাজার গোষ্ঠী থেকে প্রদত্ত ‘আনন্দ’ পুরস্কার এছাড়াও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রদত্ত ‘জগৎতারিণী’ পদক।

         চল্লিশের দশকের প্রথম অধ্যায় হল জীবন শিল্পী সুবোধ ঘোষের আবির্ভাব কাল। গত দশকের এই সময়কালে এসে লেখক নানা ধরণের রচনা করে যান। তুলনামূলক ভাবে কিছুটা বেশি বয়সে সাহিত্য জগতে তাঁর পদার্পন হলেও তিনি নিজ প্রতিভার বলে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর প্রত্যেকটি রচনায় তাঁর উর্বর মনন শক্তি এবং চিন্তন ক্ষমতার পরিচয় মেলে। বিভিন্ন ধরণের টানাপোড়েনকে অতিক্রম করে তিনি যে রচনা সম্ভার তৈরি করেন তা সত্যই অনন্যতার দাবিদার। বলাবাহুল্য বাংলা ভাষী বাঙালি সমাজে সুবোধ ঘোষের লেখাগুলি বৃহৎ অংশে প্রাসঙ্গিক এবং বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁর আগমন অভাবনীয়। এক অতীব সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে লেখক তাঁর সংগ্রামময় জীবনের কথা তুলে ধরেন নিজের রচনা গুলির মধ্যে।
        জীবন সংগ্রামী সুবোধ ঘোষ নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের বৈঠকে নিজের নাম নথিভুক্ত করেন। প্রসঙ্গত সংগ্রাম ও সংঘর্ষে ভরা আদিম জীবনের ছবি তাঁর বিভিন্ন লেখার মধ্যে বিশেষ ভাবে স্পষ্ট। তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি নিজস্ব মনন ও মেধা জাত প্রতিতীকে কাজে লাগিয়ে, নিজেকে সাহিত্যের এক অতীব সুকৌশলি রূপকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। পরিশেষে বলা চলে কালজয়ী লেখক সুবোধ ঘোষ একজন দক্ষ শিল্পীরূপে বাংলা সাহিত্যের দরবারে চিরকাল রয়ে যাবেন।