প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র : ফেলুদা
কলমে : অনন্যা সাহা, বি.এ ( বাংলা ), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
■ ভূমিকা :
বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে বিশ্বায়নের পূর্ব কাল থেকেই নানা ধরণের সাহিত্য প্রকরণের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যে সাহিত্য প্রকরণ গুলির মধ্যে গোয়েন্দা তথা ডিটেক্টিভ কাহিনী বিশেষ উল্লেখ্য। সময়ের সাথে নানান ধরণের
গোয়েন্দা চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে বিশ্বসাহিত্য জগতে, প্রসঙ্গত বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রেও এর অন্যথা ঘটেনি। কাকাবাবু, ফেলুদা,মিতিন মাসি, কিরীটী রায়,ব্যোমকেশ বক্সী, গোগোল, একেন বাবু ইত্যাদি সমস্ত চরিত্র গুলি সময়ের সাথে, বাঙালি পাঠক সমাজের ছোট থেকে বড়ো সব রকম বয়সের মানুষদের অতিন্দ্রীয় রোমাঞ্চ ও আনন্দ প্রদান করে এসেছে।
যেকোনো সাহিত্যে গোয়েন্দা হলো সেই কল্পনা উদ্ভুত চরিত্র, যে সারা আখ্যান জুরে কোনো নির্দিষ্ট রহস্যের সমাধান করে। মূলত এই চরিত্র গুলিই কিছু সহযোগী চরিত্রের সহযোগে, কাহিনীর কেন্দ্র হিসেবে লেখক নির্মিত কোনো আকস্মিক অঘটনের সত্যতা উন্মোচন করে থাকে। এই মূল চরিত্র তথা গোয়েন্দা চরিত্রের প্রকাশ মূলত এক সৌখিন ব্যক্তিত্বের আবেশে হয়ে থাকে।
হত্যা বা চুরি – ডাকাতি সম্বন্ধিয় কোনো ঘটনাকে সূক্ষ বুদ্ধি লাগিয়ে সমাধান করার দায়িত্ব নেয় এই গোয়েন্দা চরিত্রগুলি। বলাবাহুল্য লেখকবর্গ নিজেদের গোয়েন্দা চরিত্রগুলির সন্ধানী সত্তাকে কাজে লাগিয়ে, নিজেদের লিখিত নানান রচনার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের অনাকাঙ্খিত ঘটনার মীমাংসা করায়। পঞ্চানন ঘোষাল, পাঁচকড়ি দে প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ এমন ধরণের লেখনী লেখনের জন্য বিশেষ স্বকীয়তার অধিকারী।
জীবনের নানান নারকীয় ঘটনা অতীব জটিলতার সাথে বিভিন্ন গোয়েন্দা কাহিনি গুলিতে বিবৃত হয়, ফলতো এই ধরণের কাহিনি বর্গের সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র জগতে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা আজও রয়ে গিয়েছে।
■ গোয়েন্দা কাহিনির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ :
বিদেশী সাহিত্য জগতের প্রেক্ষিতে এডগার অ্যালান পোর রচিত “The Murdersin Rue Morgur” হলো প্রথম জনপ্রিয় গোয়েন্দা উপন্যাস। এর রচনাকাল হলো ১৯৪১ সাল। এর পাশাপাশি “The Mystery of Roget” (১৯৪২)এবং “The Purloined” (১৯৪৪) এই দুই গোয়েন্দা পুস্তিকাও বিশেষ জনপ্রিয়। সর্বোপরি বিদেশের গোয়েন্দা সাহিত্য অনুসন্ধান করলে বলতে হয় এমিল গাবোরিয়োর কথা। তাঁর রচিত গোয়েন্দার নাম মঁসিয়ু ল্যকক। সম্পূর্ণ গোয়েন্দা উপন্যাস তিনিই প্রথম লেখেন যার নাম ‘লাফ্যেরলারুজ’ (১৮৬৬)। তবে ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত আর্থার কোনান ডয়েল রচিত “A study in scarlet” পুস্তিকার নায়ক চরিত্র শার্লক হোমসের জনপ্রিয়তার মোকাবিলা বর্তমান কাল পর্যন্ত কেওই তেমন ভাবে করতে পারেনি। তৎকালীন সময়ের পাশাপাশি বর্তমান সময়েও শার্লক হোমসের চর্চা প্রত্যেক সাহিত্য ক্ষেত্রে অপরিবর্তনশীল রয়ে গিয়েছে। মূলত বিদেশী সাহিত্যের সুবাদেই গোয়েন্দা কাহিনীর প্রবেশ নানা স্থানের সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রথাগত ভাবে ঘটে এবং এই ভাবেই গোয়েন্দা কাহিনীর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এর ক্রমবিকাশ সংঘটিত হয়।
ক্রমে প্রথাগত ভাবে বিদেশী সাহিত্যের সংস্পর্শে এসে বাংলা সাহিত্যেও উনিশ শতকের সময়পর্বে গোয়েন্দা কাহিনীর আবির্ভাব হয়। তবে প্রথম দিকে এই গোয়েন্দা কাহিনী গুলিকে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখা হতোনা, সাহিত্য রচনার উৎকৃষ্টতার পরিমাপকাঠি অনুযায়ী গোয়েন্দা কাহিনীর অবস্থান ছিল নিম্নে। পূর্বে শিশুকিশোর সাহিত্যের প্রারম্ভীক কালে, সমাজ চিহ্নিত নিম্নস্থ বটতলার সাহিত্য অঙ্গনে গোয়েন্দা বিষয়ক পুস্তিকাসকলের স্থান ছিল। তৎকালীন সময়ে মানুষ নির্মিত উচ্চতর এবং নিম্নতর সাহিত্যের দল ভাগাভাগির কালে এই রহস্য উদ্ঘাটনের কাহিনীসমূহ অতীব দুঃখজনক ভাবেই নিম্নতর সাহিত্য শাখায় মনোনীত হয়। তবে সময়ের সাথে এর উত্থান ঘটে বিভিন্ন মহান মানুষের সৃজণশীল মননের জোড়ে।
১৮৯২ সালে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় দ্বারা রচিত “দারোগার দপ্তর ” প্রকাশ লাভ করে। এর পরে ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত হয় কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের “বাঁকাউল্লার দপ্তর”।
এছাড়া বিভিন্ন পত্রিকাতেও গোয়েন্দা কাহিনীর অবস্থান দেখা যায়। নবজীবন পত্রিকায় গিরিশ চন্দ্র ঘোষ লিখলেন “সেকালের দারোগা কাহিনী” (১৮৯৩-১৮৯৪)। ভারতী পত্রিকায় নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখলেন “চুরি না বাহাদুরি”এবং সখা ও সাথী পত্রিকায় হরিসাধন মুখোপাধ্যায় লিখলেন “আশ্চর্য হত্যাকান্ড”।
এর পরে পাঁচকড়ি রায়ের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর রচিত “রহস্য বিপ্লব”,”মায়াবিনী” ইত্যাদি লেখাগুলি বাংলা সাহিত্যে বিশেষ আলোড়নের সৃষ্টি করে।
এরও পরের দশকে নিহাররঞ্জন গুপ্তের সৃষ্ট “কিরীটি রায়”, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের “ব্যোমকেশ বক্সী”, সত্যজিৎ রায়ের “ফেলুদা”, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের “বড়দাচরণ”,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “কাকাবাবু”,হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের “পারিজাত বক্সী”, শেখর বসুর “চিন্ময়” ইত্যাদি গোয়েন্দা চরিত্র বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা কাহিনীর ঘরানাকে এক নবরূপ প্রদান করে।
■ প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্রের স্রষ্টার পরিচয় :
ছেলেবেলার স্মৃতি খনন করলে , ফেলুদা নামটা প্রায় সকলেরই স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। সত্যজিৎ রায় মহাশয় রচিত এই যুগান্তকারী চরিত্র হলো এই ফেলুদা ওরফে প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। আমার নিজের ছোটবেলার স্মৃতির সাথেও ফেলুদা চরিত্রটি অতঃপ্রত জড়িত আছে। ফাঁকা সময় পেলেই আমার ছেলেমানুষ মন ফেলুদা সমগ্রের আঘ্রানকে সন্ধান করতো। প্রসঙ্গত ফেলুদার স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়ের কথায় আসি, এই ব্যক্তি ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্রকার, নির্দেশক, লেখক,শিল্প-সংগীত পরিচালক। নিজ জীবনের প্রায় বেশির ভাগ সময়ই তিনি বিনোদন জগতের প্রতি উৎসর্গ করেন। তাঁর জন্ম হয় কলকাতা শহরের এক খ্যাতনামা পরিবারে ১৯২১ সালের ২-মে এবং তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৯২ সালের ২৩-এপ্রিল। তাঁর পূর্বপুরুষের বসত বাড়ি ছিল সেই সময়ের ব্রিটিশ ভারতের কিশোরগঞ্জে। তাঁর শিক্ষা জীবন কাটে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতনে। এছাড়া অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি ডিগ্রি লাভ করেন। চলচ্চিত্র বিনে তিনি অনেক ধরণের রচনা করেন, যার মূল প্রেক্ষাপট ছিল শিশু কিশোর সাহিত্য। কল্পবিজ্ঞানের পটে তিনি প্রফেসর শঙ্কুর মতন চরিত্রেরও স্রষ্টা। ভারত থেকে পুরস্কার স্বরূপ সত্যজিৎ রায় ভারতরত্ন এবং পদ্মভূষণও পান।
নিম্নে সত্যজিৎ রায় রচিত ফেলুদা সিরিজের কিছু গল্প ও উপন্যাসের তালিকা প্রস্তুত করা হলো :
ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি (১৯৬৫-৬৬ সন্দেশ)
বাদশাহী আংটি (১৯৬৬-৬৭ সন্দেশ)
কৈলাস চৌধুরীর পাথর (১৯৬৭)
শেয়াল দেবতা রহস্য (১৯৭০)
গ্যাংটকে গন্ডগোল (১৯৭০)
সোনার কেল্লা (১৯৭১)
বাক্স রহস্য (১৯৭২)
সমাদ্দারের চাবি (১৯৭৩)
রয়েল বেঙ্গল রহস্য (১৯৭৪)
জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৫)
গোরোস্থানে সাবধান (১৯৭৭)
হত্যাপুরী (১৯৭৯)
জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা (১৯৮৩)
রবার্টসনের রুবি (১৯৯২)।
■ প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্রের পরিচয় :
অল্প বয়সে মাতৃ-পিতৃ বিয়োগের ফলে ফেলুদা তার কাকার কাছে মানুষ হয়। ফেলুদার বাবার নাম ছিল জয়কৃষ্ণ মিত্র যিনি পেশায় শিক্ষক ছিলেন। ফেলুদা নিজের কর্মজীবন প্রথমে শুরু করে একটি বেসরকারি চাকরি দিয়ে এবং এর পরে গোয়েন্দা হয়ে নানা রহস্য সমাধানে প্রবৃত্ত হয়। রহস্য ভেদের অভিযানে তার সহযোগী ছিল তার খুড়তুতো ভাই তোপসে, জটায়ু এবং সিধু জ্যাঠা। প্রসঙ্গত তোপসের ভালো নাম ছিল তপেশরঞ্জন মিত্র ও ফেলুদার লেখক বন্ধুর ভালো নাম ছিল লালমোহন গাঙ্গুলি। এছাড়াও ফেলুদার অন্যতম শত্রু ছিল মগনলাল মেঘরাজ।
শরীরচৰ্চার পাশাপাশি সাম্প্রতিক বিষয় সম্বন্ধেও ফেলুদার জ্ঞান ছিল তুখর যা তাকে গোয়েন্দা হয়ে উঠতে বিশেষ সহায়তা করে। ২৭ বছর বয়সের প্রদোষ চন্দ্র মিত্র মার্শাল আর্ট ভালোই জানতো। জ্ঞান সমন্নিত তার মস্তিস্ক সর্বদায় ইতিবাচকতার পক্ষপাতী। অতীব বিশ্বাস ও ভরসার সাথে সন্দিগ্ধ চিত্তে ফেলুদা প্রত্যেকটি রহস্য উদ্ঘাটন করে। তার বুদ্ধিমত্তার শক্তি মগজাস্ত্র নামে পরিচিত। সাধারণ মফস্বল, থেকে কলকাতা পর্যন্ত ফেলুদা রহস্য উদ্ঘাটন করে গিয়েছে। আবার মাঝে মাঝে কলকাতা বা দেশের বাইরেও তাকে গমন করতে হয়েছে রহস্যের পিছু নিয়ে। বলাবাহুল্য নিজ তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির বলে জটিল থেকে জটিলতম সমস্যার সমাধান করে আমাদের গোয়েন্দা মহাশয়। এই সূত্রে বলা চলে যেকোনো ঘটনা ঘটলে সেই ঘটনা বিষয়ে যথা সম্ভব স্টাডি করে তবেই কাজে নামতো ফেলুদা। রহস্য সমাধানের কালে তার মন সবসময় সতর্ক থাকতো , এর ফলে অভিযানে আসা নানা বাঁধা বিপত্তিকে অনায়াসেই সে অনুমান করে তার নিরাময় করতো।
■ প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্রের বিশিষ্টতা :
ফেলুদা সিরিজ পঠন করলে,ফেলুদা চরিত্রটিকে নিয়ে নানান ধরণের প্রাসঙ্গিক বিশিষ্টতা আমাদের দৃষ্টি গোচর হয় নিম্নে সেই বিশিষ্টতা গুলিকে উল্লেখ করা হলো :
১. অন্যান্য গোয়েন্দা চরিত্রের মতনই ফেলুদা চরিত্রটিও বিশেষ মেধার অধিকারী।
২. যেকোনো কেস সমাধানের ক্ষেত্রে হটকারী ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত ফেলুদা নেয়না, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এই মানুষটি বিশেষ হিসেবি।
৩. এই চরিত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আছে বাঙালিআনার খোরাক। তার চরিত্রের বেশির ভাগ অংশই আমাদের বাঙালি স্বভাব চরিত্রের দর্পন স্বরূপ।
৪. গোয়েন্দাগিরি তার একধরণের নেশা। যে নেশার জন্য , ফেলুদা নির্দ্বিধায় রহস্যের গন্ধ পেলেই ছুটে যায় এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
৫. রহস্যপূর্ণ আবহাওয়ায় ফেলুদার দুঃসাহসিকতার সাথে , মগজাস্ত্র ব্যবহার করে যেকোনো ঘটনার তদন্ত করা এক বিশেষ গুন।
৬. লেখকের লেখার মহিমায় ফেলুদা চরিত্রটি সবরকম বয়সী পাঠকের জন্যই বিশেষ প্রভাবশালী ।
৭. ফেলুদা চরিত্রের আর একটি দিক হলো, এই চরিত্র কোনো রকম রোমান্টিকতার আবেশে গঠিত নয়।
৮. ফেলুদার চারিত্রিক বলিষ্ঠতা এতটাই যে পাঠককুল যখন ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি পাঠ করে তখন, পাঠক ও ফিকশানাল ফেলুদার মধ্যে এক অসীম আত্মস্থতার সৃষ্টি হয়। পাঠককুল যেন পঠনের সাথে সাথে ফেলুদার সঙ্গী হয়ে ওঠে এবং তারই সঙ্গে রহস্য সমাধানে এগিয়ে যায় অজানা প্রান্তরে।
৯. বৈজ্ঞানিক পটভূমি এবং আন্তর্জাতিক ঘটনাসমূহ হলো ফেলুদার রহস্য সমাধানের যাত্রার এক বিশেষ অঙ্গ।
১০. তুমুল রোমঞ্চকে অঙ্গীকার করে এবং হিংসা ও কূটনৈতিক মানসিকতাকে যথাসম্ভব বর্জন করেই ফেলুদার প্রত্যেকটি অভিযান নির্মিত।
১১. ফেলুদা সিরিজের প্রত্যেকটা আখ্যানে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কোনো রহস্যকে ঘিরেই যে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি আবর্তিত হয়েছে তা নয়। ভ্রমণ , বৈচিত্রময়তার উপস্থিতির জন্য ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি হয়ে উঠেছে অনন্য।
■ অন্যান্য গোয়েন্দা চরিত্রের সাথে প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্রের তুলনা :
সমস্ত গোয়েন্দা সাহিত্য জুড়ে ফেলুদার জনপ্রিয়তা যথেষ্ট বেশি। প্রকৃতপক্ষে গোয়েন্দা সাহিত্যের অন্যান্য চরিত্রগুলির পরস্পরের সাথে কখনোই তুলনা চলেনা। কারণ প্রত্যেকটি চরিত্রই হলো স্বতন্ত্র। বাংলা সাহিত্যের লেখকবর্গ সময়ের সাথে এই চরিত্রগুলিকে ভিন্ন ভিন্ন স্বকীয়তার আদলে গড়ে তুলেছেন। ফেলুদা হলো সত্যজিৎ রায় নির্মিত এমনি এক চরিত্র যে নিজের গুরু হিসেবে শার্লক হোমসকে বেছে নেয় ও গোয়েন্দাগিরি শুরু করে।
তবে অন্যান্য গোয়েন্দা চরিত্র গুলির থেকে ফেলুদার স্বতন্ত্রতা কোথায় আলাদা এ বিষয়ে যদি আলোকপাত করতে হয় , তবে বলা চলে ফেলুদা চরিত্রটি বিশেষ করে ছোটদের জন্যই রচিত। এতে আছে অতিরঞ্জকতা যা বাস্তবের সামাজিকতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রসঙ্গত যদি আমরা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বাবুকে ফেলুদার সাথে তুলনায় আনি তবে দেখব, ব্যোমকেশ বাবু হলো সত্যান্বষী, বাস্তবের মাটিতে পা রেখে সামাজিক প্রেক্ষাপটে তার রহস্য উদ্ঘাটন সম্পন্ন হয়। অন্যদিকে ফেলুদা নিজ জ্ঞানের উপর আস্থা রেখে তোপসে ও জটায়ুর সাথে ঝাঁপিয়ে পরে কোনো অলীক রহস্যকে সমাধান করতে যার প্রেক্ষাপট হলো অতিনাটকীয়, এর থেকেই আমরা ফেলুদা চরিত্রের স্বতন্ত্রতা একটু হলেও আন্দাজ করতে পারি।
অন্যদিকে আমাদের মনে রাখতে হবে ফেলুদার সৃষ্টি, লেখক বিশেষ করে যে শিশু-কিশোরদের কথা ভেবে করেন এর পিছনেও একটি কারণ আছে। ফেলুদা সিরিজের যাত্রা শুরু হয় সন্দেশ পত্রিকা থেকে এবং এই সন্দেশ পত্রিকা বেরোতো মূলত ছোটদের কথা মাথায় রেখেই ফলতো এই কারণ বশত ফেলুদার এডভেঞ্চারের আখ্যান গুলিতে তেমন ভাবে পূর্ণ পরিপক্কতার স্থান নেই। তবে পরিপক্কতা না থাকলেও যে ফেলুদা প্রাপ্ত বয়স্কদের কাছে নিছক কাল্পনিক চরিত্রমাত্র তা কিন্তু নয়, ফেলুদার এডভেঞ্চারের সাথে সবার মননের যে অমোঘ আবেগ জড়িয়ে আছে সেই আবেগের প্রতিস্থাপন অসম্ভব।
■ উপসংহার :
ছেলেবেলার কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীর মধ্যে গোয়েন্দা কাহিনী পঠন করলে এক অকল্পনীয় জগতের সৃষ্টি হতো যে জগতে আমরাও রহস্যের আঘ্রান পেতাম এবং এই রহস্যের তল কোথায় তা জানতেই একের পর এক কাহিনী সমাহার অনায়াসে শেষ করতাম । তবে সমস্ত রকমের কাহিনী সমাহারের মধ্যে ফেলুদা, তোপসে ও জটায়ুর জুটি যেন এখনো মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। ছেলেবেলাটা তাদের দৌলতে এতটাই সুন্দর হয়ে উঠেছিল যে আজ পর্যন্ত, ফেলুদা ব্যক্তিগত ভাবে আমার প্রিয় চরিত্র হিসেবে রয়ে গিয়েছে। পরিশেষে বলা যায়,শুধু মাত্র রহস্য সমাধান নয়, ফেলুদার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিও পাঠককুলকে মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলে। ফেলুদার প্রকৃত আবির্ভাবকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত প্রায় অনেকটায় সময় পেরিয়ে গিয়েছে তবে শিশু কিশোর সাহিত্যের দরবারে ফেলুদার গুরুত্ব কখনো কমে যায়নি। আজকের প্রজন্মের কাছেও ফেলুদা পূর্বের মতনই জীবন্ত, ফেলুদা আগের মতই এখনো দক্ষিণ কোলকাতার রজনীসেন রোডের বাড়িতে থাকে, চারমিনার পান করে এবং অতীব ঠান্ডা মাথায় বিভিন্ন রহস্যের সমাধান করে।