রাধাতত্ত্ব : চৈতন্যচরিতামৃত

কলমে – নম্রতা বিশ্বাস, এম.এ, বি.এড


       নবদ্বীপের আকাশ যখন পুরোপুরি কালো মেঘে আচ্ছন্ন ছিল সেই সময় নতুন আলো হয়ে শ্রী গৌরাঙ্গের এই বাংলায় আবির্ভাব ঘটে। যদিও পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে হোসেন শাহের রাজত্বকাল শুরু হয়েছিল বাংলায়, যার কারণে কিছুটা শান্তির পরিবেশ তখন ছিল। ফলে বলাই যায়, হোসেন শাহের রাজত্বকালে শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব নিঃসন্দেহে সমাজ – সাহিত্য – ধর্ম – দর্শন – সংস্কৃতির জগতে এক অভিনব দিক।
শ্রীচৈতন্যদেবের দিব্যঘন জীবনের প্রভাবে বাঙালি এবং বাংলা সাহিত্যের পুনর্জন্ম ঘটে। শুধু যে সাহিত্য তা নয় ধর্মে, দর্শনে, সঙ্গীতে বাঙালি নতুন এক ভাবলোকের সন্ধান পায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন – “বর্ষাঋতুর মতো মানুষের সমাজে এমন একটা সময় আসে যখন হাওয়ার মধ্যে ভাবের বাষ্প প্রচুর পরিমাণে বিচরণ করিতে থাকে। চৈতন্যের পরে বাংলাদেশের সেই অবস্থা হইয়াছিল। তখন সমস্ত আকাশ মেঘের রসে আদ্র হইয়াছিল। তাই দেশে সে সময় যেখানে যত কবির মন মাথা তুলিয়া দাঁড়াইছিল সকলকেই সেই রসের বাষ্পকে ঘন করিয়া কত অপূর্ব ভাষা এবং নতুন ছন্দে, কত প্রচুর্যে এবং প্রবলতায় তাহাকে দিকে দিকে বর্ষণ করিয়াছিল।”

শ্রীচৈতন্যদেবকে অবলম্বন করে বাংলায় সর্বপ্রথম জীবনীকাব্য রচনা শুরু হয়, এর পূর্বে কোনো জীবনীকাব্য রচিত হয়নি। শ্রীচৈতন্যদেবকে নির্ভর করে যে – সকল জীবনী কাব্য রচিত হয়েছে সেইগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’।  আলোচ্য কাব্যটিতে বৈষ্ণবদর্শনের গভীর তত্ত্বকথা নিহিত আছে।
অমৃতের আস্বাদন যেমন তৃপ্তিকর, একফোঁটা অমৃতও যেমন অনন্ত তৃপ্তি দেয় তেমনি ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ও বৈষ্ণবদের কাছে অমৃতস্বরূপ বলা যায়। কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর রচিত কাব্যে একাধিক তত্ত্বের সমাবেশ ঘটিয়েছেন, যেমন – ১) ব্রহ্মতত্ত্ব, ২) জীবতত্ত্ব,  ৩) সৃষ্টিতত্ত্ব, ৪) কৃষ্ণতত্ত্ব, ৫) রাধাতত্ত্ব, ৬) সাধ্য – সাধনতত্ত্ব, ৭) অচিন্ত ভেদাভেদতত্ত্ব, ৮) বৈষ্ণব রসতত্ত্ব, ৯) প্রেমবিলাস বিবর্তন তত্ত্ব। বলা যেতে পারে, আলোচ্য কাব্যটি যেন তত্ত্বসমুদ্র।

‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্যটি তিনটি লীলায় বর্ণিত। এখানে খণ্ডে ‘লীলা’ রূপে দেখানো হয়েছে। যথা –
১. আলোচ্য কাব্যটির প্রথম খণ্ডের নাম ‘আদিলীলা’ । এটি সতেরোটি অধ্যায় বিভক্ত। এখানে চৈতন্যদেবের জন্ম থেকে শুরু করে তাঁর সন্ন্যাস গ্রহণ পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে। বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে চৈতন্য অবতারের কারণ, অদ্বৈত – নিত্যানন্দ – মহাপ্রভুর কথা, শ্রীগৌরাঙ্গের বাল্য – কৈশোর, সন্ন্যাসকথা। আদিলীলাতে চৈতন্য অবতারের তাৎপর্যও বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া রাধাকৃষ্ণতত্ত্ব, বৈষ্ণবরসতত্ত্বও সবিস্তারে উল্লেখিত হয়েছে।
২) মধ্য লীলায় আছে পঁচিশটি অধ্যায়। অন্য দুটি খণ্ড থেকে এই খণ্ডটির অধ্যায় সংখ্যা বেশি। এখানে বর্ণিত হয়েছে মহাপ্রভুর নীলাচল গমন, সার্বভৌম – সংবাদ, দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের বিবরণ, রায় – রামানন্দের সঙ্গে সাধ্য – সাধন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা প্রমুখ।
৩) সর্বশেষ অন্ত লীলায় আছে কুড়িটি অধ্যায়। মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণ, রাঢ়দেশ ভ্রমণ, নীলাচলে গমন , সার্বভৌমকে স্বমতে আনয়ন, দক্ষিণ – ভারত যাত্রার বিবরণ। চৈতন্যদেবের নীলাচল জীবনের বিশেষ দিক ছাড়াও অসংখ্য তত্ত্ব এখানে বর্ণিত হয়েছে। ছোটো হরিদাসের শিক্ষা, সনাতন প্রসঙ্গ, রঘুনাথ প্রসঙ্গ, গোপীনাথ পট্টনায়ক উদ্ধার বিবরণ, হরিদাস নির্বাণ প্রসঙ্গ প্রমুখও এখানে আলোচিত হয়েছে।

       বৃন্দাবনের ভক্তগণ বাংলাভাষায় এমন একটি চৈতন্য জীবনীর প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন যেখানে চৈতন্য দেবের উত্তর জীবনী ও গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের নিগূঢ় তত্ত্বরস সরল ভাষায় সাধারণের মতো করে ব্যাখ্যা করা থাকবে। কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ সেই কথা মাথায় রেখেই রচনা করলেন ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্যটি। কবি চৈতন্য দেবের আবির্ভাবের মুখ্য কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন –
“শ্রীরাধায়া : প্রণয়মহিমা কীদৃশো বানয়ৈবা
স্বাদ্যো যেনাদ্ভুতমধুরিমা কীদৃশো বা মদীয়।
সৌখ্যং চাস্যা মদনুভবতঃ কীদৃশং বেতি লোভা
ত্তদ্ভাবাঢ়্যঃ সমজনি শচিগর্ভসিন্ধৌ হরীন্দুঃ।।”
অর্থাৎ, শ্রীরাধার‌ প্রেম মাহাত্ম কেমন‌ এই প্রেমের দ্বারা রাধা কৃষ্ণের যে অদ্ভুত মাধুর্য্য আস্বাদন করে রাধা যে সুখ পান সেই সুখই বা কেমন এই সমস্ত বিষয়ে জানার ইচ্ছার কারণেই রাধার ভাব গ্রহণ করে কৃষ্ণ শচীগর্ভে চৈতন্যদেব রূপে আবির্ভূত হয়েছেন।

      ভগবানের অনন্ত শক্তির মধ্যে তিনটি শক্তি হলো – অন্তরঙ্গা চিচ্ছক্তি, বহিরঙ্গা মায়াশক্তি এবং তটস্থা জীবশক্তি। অন্তরঙ্গা চিচ্ছক্তিকে ব্যাখ্যা করলে দেখা যায় এর আবার তিনটি ভাগ ‘সৎ( সন্ধিনী)’, ‘চিৎ ( সম্বিৎ)’, ‘আনন্দ ( হ্লাদিনী)’ , ‘সৎ’- এর থেকে ‘প্রকাশ অবস্থান ধাম বা আধার’-এর  উৎপত্তি, ‘চিৎ’- এর থেকে উৎপত্তি ‘প্রকাশ – ভগবত্তা সম্পর্কে জ্ঞান’, সর্বশেষ ‘আনন্দ’ – এর থেকে ‘প্রেম’-এর উৎপত্তি,  প্রেম থেকে উৎপত্তি ভাবের, ভাব থেকে মহাভাবের উৎপত্তি, আর মহাভাব থেকে উৎপত্তি মহাভাব স্বরূপা শ্রীরাধা ঠাকুরানীর। অন্তরঙ্গা শক্তির আনন্দ অংশের মূল আধার হলেন রাধা। শ্রীকৃষ্ণ হ্লাদিনী সত্তায় নিজে আনন্দ অনুভব করেন এবং আপ্লুত হন। জীবজগৎকে তিনি এই কথা বলতে চান যে, তাঁকে দুবাহু বন্ধনে তথা হৃদিরাসমন্দিরে রাখতে চাইলে শ্রীমতি রাধার মতো সর্বসুখ বিসর্জনের সুকঠিন সংকল্প করতে হবে। বলাবাহুল্য প্রেম হলো হ্লাদিনী শক্তির মূল ভাব, প্রেমের সর্ববিধ তাৎপর্যে তাঁর একাধিপত্য । সুতরাং কৃষ্ণ প্রেমের গৌরবে, সৌন্দর্যে, আনন্দ আস্বাদনের ক্ষমতায়, ত্যাগে সবার উপরে তিনি। ফলে শ্রীরাধিকার সঙ্গে কৃষ্ণপ্রেমের সম্পর্ক হল ‘রাগাত্মিকা’ বা প্রতক্ষ প্রেম এবং জীবগতের সঙ্গে কৃষ্ণপ্রেমের অধিকার সম্পর্কিত বিষয় হলো ‘রাগানুগা’ বা পরোক্ষ প্রেম।
      রাগাত্মিক প্রীতিরসের প্রথম অবস্থাকে ‘রতি’ বলা হলে পরবর্তী অবস্থাকে ‘প্রেম’ বলা হয় । রতির গাড়তাই প্রেম ঘণীভূত‌ করে , আরো ঘনীভূত হতে হতে ক্রমান্বয়ে স্নেহ, মান, প্রণয়, রাগ, অনুরাগ এবং ভাবে গিয়ে পৌছায়। সাধারণভাবে গোপীদের প্রেম এই ‘ভাব’- অবস্থা পর্যন্ত যেতে পারে। কিন্তু ভাবই শেষ নয়।

ভাবের উপরে যে অলৌকিক অপরিমেয় মানসিক অনুভব রয়েছে তা হল ‘মহাভাব’ এবং এই অবস্থার অধিকারিণী শ্রীরাধাকে ধরা হয়ে থাকে। মহাভাবের অবস্থায় স্তম্ভ, স্বেদ, অশ্রু প্রভৃতি সাত্ত্বিক বিকারগুলি ঘনঘন প্রকাশিত হয় বলে একে ‘রূঢ়’ মহাভাব বলা হয়  আর স্বাত্ত্বিক পরকাষ্ঠা লাভ করলে বা সু- উদ্দীপ্ত হলে সেই অবস্থাকে ‘অধিরূঢ়’ মহাভাব বলা হয়ে থাকে । অধিরূঢ় মহাভাব আবার দুই ভাগে বিভক্ত ‘মোহন’ এবং ‘মাদন’ , এই দুইটি কৃষ্ণ প্রেমের পরিণামের অবস্থা ধরা হয়ে থাকে। নীলাচল লীলায় মহাপ্রভুর এই ভাবাবস্থা অনেক ভক্তরাই স্বচক্ষে দেখতে পেরেছিলেন।
এর থেকেই এই অবস্থাকে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা রাধার অনুরূপ ভাবাবস্থা কল্পনা করেছেন। মোহন হল প্রেমের বিরাহাশ্রিত একত্বের সীমা, আর মাদন‌ হল মিলনগত একইভাবের ঘনীভূত অবস্থা।

কৃষ্ণদাস কবিরাজ ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্যে প্রথম পরিচ্ছেদের পঞ্চম শ্লোক বলেছেন –
“রাধা কৃষ্ণপ্রণয় বিকৃতিহ্লাদিনী শক্তিরস্মা
দেকাত্মানাবপি ভুবি পুরা দেহভেদং গতৌ তৌ।
চেতন্যাখ্যাং প্রকটমধুনা তদ্দ্বয়ং চৈক্যমাপ্তং
রাধাভাবদ্যুতি সুবলিতং নৌম কৃষ্ণস্বরূপম।।”
রাধাগোবিন্দ নাথ মহাশয় এই শ্লোকেটির অনুবাদে বলেছেন – শ্রীরাধিকা, শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়ের বিকার – স্বরূপা ( কৃষ্ণপ্রেমের গাঢ়তম অবস্থা মহাভাব – স্বরূপা ); সতুরাং শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। এজন্য ( শক্তি ও শক্তিমানের অভেদ বশত : ) তাঁহার ( শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণের একাত্মা, হইয়াও তাহার অনাদিকাল হইতেই গোলোকে পৃথক দেহ একাত্ম প্রাপ্ত হইয়া শ্রীচৈতন্য নামে প্রকট হইয়াছেন। এই রাধা – ভাব কান্তি যুক্ত কৃষ্ণস্বরূপ শ্রীচৈতন্যকে আমি নমস্কার করি – স্তব করি।”

এই শ্লোকের ব্যাখ্যায় কৃষ্ণদাস কবিরাজের বলেছেন –
“রাধা – কৃষ্ণ এক আত্মা, দুই দেহ ধরি ।
অন্যোন্যে বিলসে, রস আস্বাদন করি।।
সেই দুই এক এবে চৈতন্যগোসাঞি ।
রস আস্বাদিতে দোঁহে হৈলা এক ঠাঁই।। ”
অর্থাৎ, রাধা ও কৃষ্ণ এক আত্মা। রাধা কৃষ্ণেরই হ্লাদিনী শক্তি। শক্তি ও শক্তিমানের অভেদের কারণেই রাধা – কৃষ্ণ স্বরূপত: এক ও অভিন্ন। তবু লীলারস আস্বাদন করার জন্য ভিন্ন দেহ ধারণ করে লীলা – বিলাস করেছেন। কিন্তু পুনরায় এই রস আস্বাদন করার জন্য রাধা ও কৃষ্ণ মিলিত বিগ্রহ চৈতন্যদেব রূপে আবির্ভূত হয়েছেন।
বৈষ্ণব সাহিত্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু যাঁকে ধরা হয় তিনি হলেন শ্রীমতি রাধিকা।

     ‘কৃষ্ণসুখৈকতাৎপর্যময়ী’ প্রেমের সারভূত সত্তা হিসেবে বিবেচিত করা হয়ে থাকে রাধাকে। কৃষ্ণ প্রেম রাধা আশ্রয়ী এবং মাধুর্য প্রণয় মহিমার সর্বাত্মক প্রকাশ রাধাকে ধরা হয় জন্য বৈষ্ণব কবিতাগুলোও অনুরূপে রাধাকেন্দ্রিক হয়েছে। চৈতন্য উত্তরযুগের রাধাপ্রেম সম্পূর্ণভাবে আধ্যাত্মিক, লৌকিকতা সেখানে দূরস্থিত। যে রাধা রাখালিয়া সুরে, ভাটিয়ালির টানে কথকতার গল্পে চর্চিত হতেন তিনি চৈতন্যমহাপ্রভুর প্রেমরসে জারিত হয়ে মহাভাব স্বরূপে পরিণত হলেন চৈতন্যপরবর্তী সময়ে। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে এই রাধাভাবকে বলা হয়ে থাকে রাধাতত্ত্ব। গৌড়িয় বৈষ্ণব পদকর্তারাও শ্রীচৈতন্যদেবের মতো প্রথম রাধাভাবে ভাবিত হতেন এবং পরবর্তীতে কৃষ্ণসাধনা করতেন।
রাধা হল কৃষ্ণ প্রেমের বিকার স্বরূপ বা প্রেমের চূড়ান্ত অবস্থা –
“রাধিকা হয়েন কৃষ্ণের প্রণয় বিকার।
স্বরূপশক্তি হ্লাদিনী নাম যাঁহার ।।”
শ্রীকৃষ্ণ সর্বদা শ্রীরাধার প্রেমের মাহাত্মে আপ্লুত হন। কেননা রাধার প্রেম হল বাঁধনহারা। কোনো মায়ার প্রভাবে শ্রীরাধিকার প্রেমকে কৃষ্ণ বহির্মুখী করতে পারে না। কিন্তু মায়ার প্রভাবে বশীভূত জীব কৃষ্ণমুখী হওয়ার ইচ্ছাসুখ থেকে হয় বঞ্চিত। তাই তাঁদের প্রেম ‘নিকষিত হেম’ হয়ে ওঠার সুযোগ পায় না। যে প্রেমের সংজ্ঞায় কৃষ্ণদাস কবিরাজ “ কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ” -এর উল্লেখ করেছেন –
“আত্মেন্দ্রিয় – প্রীতি‌ – ইচ্ছা তারে বলি কাম ।
কৃষ্ণেন্দ্রিয় – প্রীতি – ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম ।। ”
এই প্রেমের একমাত্র প্রতিনিধি হলেন শ্রীমতি রাধিকা। হ্লাদিনী শুদ্ধসত্ত্বের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে কবি বলেছেন-
“হ্লাদিনী সার ‘প্রেম’ প্রেমসার ‘ভাব’।
ভাবের পরমকাষ্ঠা – নাম ‘মহাভাব’।।
মহাভাবস্বরূপা – শ্রীরাধা – ঠাকুরানী ।
সর্বগুণখনি কৃষ্ণ – কান্তা শিরোমণি ।। ”
অর্থাৎ, কৃষ্ণের আনন্দাংশে যে হ্লাদিনী শক্তির প্রকাশ তার ঘনীভূত নির্যাস হচ্ছে ‘প্রেম’ । প্রেমের সারভূত অংশ ভাব, আবার ভাবের চরম অবস্থা বা গাঢ়তম পরিণতি হল ‘মহাভাব’। আর এই মহাভাব স্বরূপের মূর্ত বিগ্রহ হচ্ছেন ‘কান্তাশিরোমণি’ রাধা।
রাধা প্রাকৃত কোন রমণী নয়। তাঁর প্রেম প্রবৃত্তি সর্বস্ব নয়, প্রবৃত্তি সম্পর্ক শূন্য অপ্রাকৃত প্রেম। কৃষ্ণের নিজশক্তিকে আস্বাদন করার জন্য রাধার প্রয়োজন। কেননা তিনি শ্রীকৃষ্ণের সহকারী শক্তি –
“কৃষ্ণপ্রেম ভাবিত যাঁর চিত্তেন্দ্রিয় কায়।
কৃষ্ণ নিজশক্তি রাধা ক্রীড়ার সহায়।।”

সতুরাং, পরমপুরুষ থেকে পৃথক দ্বিতীয় কোনো সত্তা নন রাধা রানী। রাধা ও কৃষ্ণ অভেদ। শুধুমাত্র লোকচক্ষেই পুরুষ ও প্রকৃতির ভেদ বর্তমান। তাঁদেরকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখা যায়। বলা যায় একই শক্তির অবিচ্ছিন্ন দ্বৈতরূপ। এটি আত্মার পৃথক দুটি দেহ কল্পনা মাত্র। নাহলে আর কোনো ভেদ লক্ষ করা যায় না –
“রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি ।
অন্যোন্যে বিলাসে রস আস্বাদন করি ।।”

শ্রীকবিরাজ গোস্বামী রাধা – কৃষ্ণের অভিন্নতা প্রসঙ্গে আরও সুনিশ্চিত ভাবে দার্শনিক তত্ত্বে পৌঁছাতে গিয়ে বলেছেন –
“রাধা পূর্ণশক্তি কৃষ্ণ পূর্ণ শক্তিমান।
দুই বস্তু ভেদ নাহি শাস্ত্র প্ররমাণ ।।
মৃগমদ তার গন্ধ – যৈছে অবিচ্ছেদ।
অগ্নি – জ্বালাতে যৈছে নাহি কভু ভেদ।
রাধাকৃষ্ণ ঐছে সদা একই স্বরূপ।
লীলারস আস্বাদিতে ধরে দুই রূপ।।”
অর্থাৎ, পূর্ণ শক্তিমান হলেন শ্রীকৃষ্ণ আর পূর্ণশক্তি হলেন শ্রীরাধা। উভয়ের মধ্যে কোনো ব্যবধান রচিত হয়নি। শ্রীকৃষ্ণ যখন যে অবতারে যে যুগে যেমন লীলা করেছেন তাঁর প্রেয়সীও সেইরূপ তাঁর লীলার সহকারিনী হয়েছেন ।
শ্রীরাধা সমস্ত কামনা পূরণ করেন শ্রীকৃষ্ণের, তিনি নিত্য সুখ লাভ করেন, শ্রীরাধার অমলিন প্রেম সরোবরে অবগহন করে। কৃষ্ণ, রাধিকার প্রেম উন্মক্ত হন তাঁর মহিমান্বিত প্রেমের কাছে বশীভূত হন, চির ঋণী থাকেন। এই প্রেমে কৃষ্ণ বিহ্বল হন –
“না জানি রাধার প্রেমে আছে কত বল ।
যে বলে আমারে করে সর্বদা বিহ্বল।। ”

      বিশুদ্ধ ভক্তি ভগবৎ প্রেম প্রাপ্তির একমাত্র উপায়। ভগবান তাঁর বহিরঙ্গ শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন জীবজগৎ। জীবজগৎকে আপন প্রেমের অনন্ত মহিমা ব্যক্ত করার জন্যেই তিনি শ্রীমতী রাধারানীকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ দেখিয়েছেন। রাধার প্রেম যেহেতু অন্যান্য প্রেমের থেকে ভিন্ন এই কারণেই তাঁর প্রেম বৈষ্ণবতত্ত্বে স্বীকার্য। শ্রীমতি রাধাকে শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি রূপে ধরা হয়। এছাড়া বলা হয়ে থাকে, শ্রীচৈতন্য দেবের মধ্যে রাধা কৃষ্ণের প্রেমের স্বরূপ লক্ষ করা গিয়েছিল এবং তিনি এই দুই সত্তার মিলিত রূপ। এইভাবেই ব্যক্তি রাধার ‘প্রেম’ গৌড়িয় বৈষ্ণবতত্ত্বের প্রভাবে ‘রাধাতত্ত্ব’ রূপে পরিবর্তিত হয়েছে।