শ্রীকান্ত (প্রথম পর্ব) উপন্যাসে সমাজচিত্র
কলমে: পূজা দাস; বাংলা স্নাতকোত্তর (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)
“নিজের সুখ দুঃখ দ্বারাই হ’ক, অন্যের সুখ-দুঃখের দ্বারাই হ’ক। প্রকৃতির বর্ণনা করেই হ’ক আর মনুষ্য চরিত্র গঠিত করেই হ’ক। মানুষকে প্রকাশ করতে হবে। সাহিত্যে আর সমস্ত উপলক্ষ্যে।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা উপন্যাসের অভূতপূর্ব বিকাশ, পরিবর্তন ও রূপান্তর লক্ষ্য করা যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে এই ধারার সার্থক সূচনা ঘটেছিল। যখন একদিকে রবীন্দ্রনাথের গল্পে ও উপন্যাসের বিচিত্র ঐশ্বর্য ও সূক্ষ্ম তাৎপর্য এবং প্রভাত কুমারের রচনার প্রসন্ন মাধুর্য নিয়ে বাঙালি পাঠক সমাজ তখন সন্তুষ্ট। ঠিক সেই সময়ে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের মেঘমুক্ত নির্মল আকাশে ঔষধিনাথ চন্দ্রের মত উদয় হয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের কল্পচারী প্রেম ও রোমান্সের বিপুল ঐশ্বর্যকে তিনি উপন্যাসের উপাদান হিসাবে তেমন ভাবে গ্রহন করেননি। শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু রূপে নিয়েছিলেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের গ্রাম্য সমাজকে। তাই গ্রাম জীবনের বিভিন্ন চরিত্র ওসমাজ সম্পর্কে ধারনা তথা সেই সমাজের অনুশাসনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সকল কথাই ধরা পড়েছে তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসগুলিতে। ‘শ্রীকান্ত’ একটি আত্মজীবন-নির্ভর উপন্যাস। জীবনের কথা লিখতে বসে অদৃশ্য চিত্রকরের আঁকা অন্তর্জীবনের ছবি গুলো যেমন কেউ কেউ সাজিয়ে দিয়ে যান, সেই ভঙ্গীতেই শ্রীকান্ত তাঁর আত্মজীবনের গল্প বলে গেছেন। শ্রীকান্তের জবানীতে শরৎচন্দ্র নিজের অভিজ্ঞতার অস্পষ্ট ধারনা গুলিকে বাস্তবে না রেখে সৃষ্টির অনিবার্য কৌশলে তাকে ‘সাহিত্যিক বাস্তবে’ উত্তীর্ণ করে দিয়েছেন। আর সেই প্রসঙ্গেই উঠে এসেছে সমাজচিত্রের কথা, যা আমাদের আলোচনার বিষয়।
■ শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে সমাজ:
“উপন্যাস রচিত হতেই পারেনা যতদিন পর্যন্ত না সমাজের অনুভূত সমস্যা ও শিল্পের দায় খুব কাছাকাছি প্রায় অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠছে। রোমান্সের খোলস মুক্ত হয়েছে উপন্যাসের জন্ম, সেই উপন্যাসের দাবি ছিল বাস্তবতা, পাঠকের বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা। তাই উপন্যাস নেমে আসে মাটির সংসারে জীবনের কাছাকাছি। উপন্যাসের সঙ্গে জীবনের ঘনিষ্ট সম্পর্ক”।(হেনরি জেমস)
আরো স্পষ্ট ভাষায়, স্বাভাবিকভাবে উপন্যাস একটি বস্তুনিষ্ঠ ও সমাজ ঘনিষ্ঠ শিল্প। সামাজিক উপন্যাসের প্রকৃতি স্পষ্ট করে বোঝার ক্ষেত্রে বাংলা কথা সাহিত্যে সামাজিক সমস্যা যাঁর রচনার অধিক প্রাধান্য পেয়েছে তিনি হলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সময়ের গতির সঙ্গে সাহিত্যের গতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। এর সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয় সাহিত্যের আস্বাদনের বিষয় ও পদ্ধতিরও। শরৎচন্দ্রের বিষয় নির্বাচন ও সৃজনী প্রতিভায় পাঠক মহলের মন জয় করে নিয়েছিলেন। গল্প বা উপন্যাস লেখকেরা সমকালের সমাজ ও সমকালের মানুষদের আশ্রয় করে কাহিনী রচনা করেন। যদিও বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে ছিল মোগল যুগের ইতিহাস থেকে আধুনিক নরনারীর মনস্তাত্ত্বিকতার ছবি। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের ক্ষেত্রে সমকালকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং শরৎচন্দ্রের সব গল্প ও উপন্যাস সমকালীন সমাজের প্রেক্ষাপটে রচিত।
শরৎচন্দ্র নিজের ভাষায় ব্যক্ত করছেন, “দেশের নব্বই জন যেখানে বাস করেন সেই পল্লীগ্রামেই আমার ঘর। মনের অনেক আগ্রহ, অনেক কৌতূহল দমন করতে না পরে অনেক দিনই ছুটে গিয়ে তাঁদের মধ্যে পড়েছি এবং তাঁদের বহু দুঃখজনকভাবে বহু দৈন্যের আজও আমি সাক্ষী হয়ে আছি।” (স্বদেশ ও সাহিত্য)
শরৎচন্দ্রের সমাজভাবনা বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথের মতো নীতি, সৌন্দর্য- বিবেকের প্রশ্নে আলোড়িত হয়। শরৎচন্দ্রের সমাজ ছিল বিশেষভাবে পল্লীসমাজ। বাংলার পল্লীসমাজের সংকীর্ন প্রথা পোষিত জীবনযাত্রার অন্তরালে নির্বাসিত। প্রেম কিভাবে গুমরে মরে, সংস্কার ও সতীত্বের দুমুখো অস্ত্রের আঘাতে নারী মন কিভাবে ক্ষত বিক্ষত হয়, ন্যায়-বিধানের নামে মানুষকে স্বর্গে পাঠানোর চিন্তায় উচ্চবর্ণের সমাজপতিরা যে প্রবল অত্যাচার করে, শরৎচন্দ্রসাহিত্য হল তার জীবন্ত দলিল। এই সমস্ত দিক সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তাঁর সামাজিক উপন্যাস গুলিতে –
‘পল্লীসমাজ‘(১৯১৬) উপন্যাসে সামাজিক কুপ্রথার প্রতি কটাক্ষপাত হয়নি। কিন্তুু হিন্দু সামাজের প্রকৃত আদর্শ ও মনোভাব সম্পন্ন সমগ্র জীবনযাত্রার একটা নিঁখুত প্রতিকৃতি তুলে ধরে হয়েছে। গ্রামের ছেলে রমেশ দীর্ঘ প্রবাহের পর পিতৃহীন হয়ে ফিরে এসেছে, বাল্য প্রেমের নায়িকা রমা তখন বিধবা। গ্রামের ভালো করার যাবতীয় প্রচেষ্টা তার বিফলে যায়, সমাজ পতিদের কূটকাচালি ও ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে। এর মধ্যে আবার রমেশ ও রমার অস্ফুট প্রণয় সম্পর্ক আরো জটিলতা তৈরি করে। ‘অরক্ষণীয়া’তে (১৯১৬) সামাজিক দুঃশাসনের চিত্র অনেক তীব্র ও নির্মম ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জ্ঞানদার অসহনীয়তা চরমসীমায় পৌঁছায় তখনি, যখন তার গর্ভবতী মা পর্যন্ত ভ্রান্ত ধর্ম সংস্কারের চক্রে পড়ে, বিশ্বব্যাপী উৎপীড়নের কেন্দ্রস্থলে গিয়ে দন্ডায়মান হয়। এরপরে আসে বিবাহমঞ্চে অতুলের প্রত্যাখ্যান, যা জ্ঞানদাকে চরমভাবে অপমানিত করে। অবশেষে উপন্যাসের শেষে জ্ঞানদার মাতৃশ্মশানে অতুলের সঙ্গে তার এক পুনর্মিলন ঘটিয়েছেন। ‘বামুনের মেয়ে’ (১৯২০) কৌলিন্য প্রথার কুফল ও কৌলিন গর্বের অসংগতি ও অন্তঃসারশূন্যতা এই উপন্যাসের আলোচ্য বিষয়। অরুণ ও সন্ধ্যার প্রেমের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে খুবই নিখুঁতভাবে। ‘পন্ডিতমশাই‘ (১৯১৪)-এ বৃন্দাবন ও কুসুমের পরস্পর ব্যবহারের মধ্যে ঘাত-প্রতিঘাত, তাদের পুনর্মিলনের পথে নতুন নতুন বাঁধার সৃষ্টি সমাজচিত্রে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। কুসুমের পক্ষে প্রধান বাঁধা ছিল বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে তাহার ভদ্র, উচ্চবর্ণোচিত প্রবল সংস্কার অপরদিকে বৃন্দাবনের পক্ষে প্রধান বাঁধা কুসুম কর্তৃক তাহার মাতার অপমান। মহিম ও সুরেশের আকর্ষণে পথভ্রান্ত ভারসাম্যহীন অচলার জীবনের পরিচয় ‘গৃহদাহে’ অভিব্যক্ত। এখানে আবেগের তীব্রতা, নারীর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, পাপপুণ্য, নীতিবোধ, সংস্কারাচ্ছন্ন চিত্রের প্রকাশে নারী মনের সুগভীর মনস্তত্ত্ব এখানে বিবৃত। এছাড়াও ‘শ্রীকান্ত’ (প্রথম পর্ব) উপন্যাসে দেখা যায়- অন্নদা দিদি, নিরু দিদি, ইন্দ্রনাথ, নতুনদা ইত্যাদি চরিত্রের পাশে শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মীর কাহিনী অসাধারণ জনপ্রিয়তা মণ্ডিত। একদিকে সমাজ সমস্যা, নীতি দুর্নীতির উপস্থাপনা যেমন রয়েছে, অন্যদিকে স্মৃতিচারণার সুরে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রকাশ পাওয়া যায়।
■ শ্রীকান্ত উপন্যাস রচনাকালে তৎকালীন সমাজ:
শরৎচন্দ্র ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের মাধ্যমে তৎকালের নানা অসঙ্গতি, কদাচার, সামাজিক প্রথার নিষ্ঠুরতা, নীচতা, কুসংস্কার প্রভৃতির লোকসমুখে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। শরৎ সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, তখন ভারতবর্ষের রেনেসাঁসের যুগ। ভারতীয়দের জাতীয় জীবনে প্রবল আলোড়ন ও সংঘর্ষে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। ইংরেজ বিরোধী মনোভাব ও সামন্ততান্ত্রিকতার অনুশাসনে তৎকালীন নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সমকালের বা তৎকালের গ্রামীণ সমাজের বাস্তবতা তিনি বাঙ্গালীর পাঠকের কাছে সার্থকভাবে উন্মোচিত করেছেন। এমনকি নর-নারীর স্বাভাবিক সম্পর্কের সঙ্গে সমাজ-নীতির দ্বন্দ্ব – তৎকালীন যুগে চিন্তাধারার মধ্যে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল শরৎচন্দ্র তাকে পরিচ্ছন্নভাবে রূপ দিয়েছেন ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের মাধ্যমে।
ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে,“শরৎচন্দ্র বাস্তব জীবনকে গ্রহণ করে অতি বিচিত্র কৌশলে তার সঙ্গে রোমান্সের অদ্ভুত মিল ঘটিয়েছেন”।
শরৎচন্দ্র তৎকালীন সময়ের অধিকাংশ সামাজিক সমস্যাকে তিনি কোনো না কোনো উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। তাঁর উপন্যাসে উঠে এসেছে তৎকালীন বহুবিবাহ, পণপ্রথা, কৌলিন্য প্রথা, স্থলিতা নারীর সমস্যা, অস্পৃশ্যতা, জাতপাত, কৃষকের সমস্যা, পল্লী গ্রামের সামাজিক অবস্থার কথা। আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে বিশাল আকারে উপন্যাস লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র, আর সেই উপন্যাসটি হলো ‘শ্রীকান্ত’। তৎকালের সনাতন ধর্মের ভেতরে জাতপাতের বিষ নিহিত ছিল। সেই সময় চরিত্রের মুখ দিয়ে এমন সরল চিরন্তন মানবিক বাক্য প্রকাশ করা একরকম দুঃসাহসের কাজ। কারণ তৎকালীন সমাজ একদিকে যেমন ছিল ইংরেজ বর্বর জাতির অত্যাচার ছিল, তেমনি ছিল ক্ষমতালোভী সমাজপতির দলেরা। ধরা যায়, উপন্যাসটি একশ বছর আগেকার বাঙালি জীবনযাত্রার একমাত্র প্রামানিক দলিল। তৎকালীন ও সমকালীন সময়ের প্রেক্ষিতে ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাস অসাধারণ অনবদ্য এবং মহান একটি মানবিক উপন্যাস হিসাবে গড়ে উঠেছে।
■ শ্রীকান্ত উপন্যাসে সমাজ:
মানুষ মাত্রেই সামাজিক জীব, তাই তার রচিত উপন্যাসে সমাজের প্রভাব থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসকে বিশেষ ধর্মের আলোকে বিচার করতে গিয়ে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন –
“বহুরূপী জীবনপট বিধৃত বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। তিনি জীবনে বহু মানুষ ও ঘটনার সংস্পর্শে এসেছেন। এই সমস্ত কিছুর প্রসাদ তাঁর উপন্যাসে মেলে।”
বাঙালি হিন্দু গৃহে সমাজ সংস্কার ও সামাজিক দুঃখ বেদনাকে অবলম্বন করে পর্যবেক্ষণের নিবিড়তা, বিশ্লেষণের সূক্ষ্মতা, বর্ণনার বাস্তবতা, উদ্দেশ্য প্রনোদান, ব্যাকুলতা ও প্রবল হৃদয় আবেগের সাহায্যে অমর কথাশিল্পী সহজ মনস্ক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি নানা কাহিনী ও ঘটনার আঙ্গিকে, নানা চরিত্রের আঙ্গিকে শ্রীকান্ত উপন্যাসের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। এই ‘আঙ্গিক’ কি? তা সম্পর্কে আমাদের অবগত হওয়া দরকার। আঙ্গিক হল উপন্যাসের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য যেখানে উপন্যাসটির কাহিনী কিভাবে গড়ে তোলা হবে অথবা উপন্যাসের গঠন কৌশল প্রক্রিয়াকে বোঝায়। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাস মূলত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস হলেও এটি মূলত সমাজ জীবনের আঙ্গিকে গঠিত।
■ কাহিনীর আঙ্গিকে:
কাহিনি উপন্যাসের প্রাণবিন্দু, কাহিনি ছাড়া উপন্যাস অচল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই কাহিনীকেই অবলম্বন করে উপন্যাসের সামাজিক চিত্রকে পাঠকের সম্মুখে তুলে ধরেছেন। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে কয়েকটি ঘটনা বা কাহিনী কে তুলে ধরে সমাজের প্রকৃত রূপটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। নারী মনের স্বাধীনতা শরৎচন্দ্র উপন্যাসের প্রধান বিষয়। সমাজে তিনি সেই সব নারীদের তুলে ধরেছেন যারা সমাজে অপমানিত, অত্যাচারিত ও অবহেলিত। নারীদের উৎপীড়িত জীবনের কাহিনী তিনি উপন্যাসের আঙ্গিক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সামাজিক নানা কুপ্রথার জালে জড়িয়ে পড়েছে এই নারী মন ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের সমাজ ব্যবস্থায় তাই উঠে এসেছেন নারীরা।
● বাল্যবিবাহ: সমগ্র সরৎ সাহিত্য জুড়ে বাল্যবিবাহ প্রথা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। এই প্রথার বিষবাষ্পে সমাজ যে কতটা জর্জরিত হয়েছিল তার বড় পরিচয় মিলে রাজলক্ষ্মী, অন্নদাদিদি, নিরুদিদি, গৌরী তেওয়ারির মেয়েদের করুন কাহিনীর মধ্য দিয়ে। হিন্দু সমাজপতিদের কাছে বাল্যবিধবারা যে কতটা হীন জাতি ছিল তার প্রমাণ নিরু দিদির শেষ জীবনের মর্মান্তিক কাহিনীতে বর্নিত হয়েছে। যেখানে গ্রামের প্রতিটি লোকেই তার সেবা উপভোগ করেছিল, ৩০ বছর বয়সে সেই বাল্যবিধবা নিরুদিদির যখন হঠাৎ পদ্মস্থলন হল তখন সেই স্বার্থপর সমাজ নিরুদিদির মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল- “হতভাগিনী নিরুদিদি বাল্যবিবাহ হয়েও যখন সুতিকা রোগে আক্রান্ত হইয়া- ছয়মাস ভুগিয়া ভুগিয়া মারা গেলেন, তখন সেই মৃত্যুশয্যার পাশে আমি ছাড়া আর কেহ ছিল না।”
● কৌলিন্য প্রথা: শরৎচন্দ্র শ্রীকান্ত উপন্যাসে নারী সাহিত্য ধারায় উঠে এসেছে রাজলক্ষী, আর এই রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে আমরা পরিচিত হই তৎকালীন কৌলিন্য প্রথা সম্পর্কে। নারীরা সমাজে কিভাবে অবহেলিত হতো তারই পরিচয় শরৎচন্দ্র শ্রীকান্ত উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই কৌলিন্য প্রথার প্রভাবে রাজলক্ষ্মী বাইজিতে পরিণত হয়েছে। শ্রীকান্ত স্মরণ করে দেখেছে রাজলক্ষ্মী জীবনে যে ইতিহাস তার জানা তা হয়তো এ দেশের মেয়েদের তৎকালীন বিধিলিপি। কুলীন পাত্রের হাতে দুই কন্যাকে তুলে দিয়ে তাদের অভিভাবকেরা মনৈ মনে নিশ্চন্ত থাকলেও। তারা এটা ভেবে দেখেনি যে এতে তার কন্যাদের পরিনতি কি হতে পারে। এর জলজ্যান্ত প্রমান মেলে শ্রীকান্ত উপন্যাসে রাজলক্ষ্মী ও সুরলক্ষীর জীবনকাহিনি পাঠ করলে। ব্রাহ্মণের জাতি রক্ষা করার পরিণামে বিবাহবাবদ সত্তর টাকা হাতিয়ে কুলীন জামাইয়ের চিরতরে পলায়ন। এর ফল ভুগছিল নিয়মতান্ত্রিক সমাজ নয়, সেই দুই বোন। মামার সংসারে তাদের জায়গা না হওয়ায় বিধবা মাকে নিয়ে তাদের হতে হয়েছিল কাশীবাসী। সেখানেই অসহায় সুরলক্ষীর প্লীহা জ্বরে মৃত্যু হয়। আর নিজের জীবনধারনের জন্য রাজলক্ষ্মীকে বেছে নিতে হয় এই বাঈজী বৃত্তি। রাজলক্ষ্মীর মর্মবেদনায় স্পষ্ট ফুটে ওঠে,”এক হিসাবে আমি যে মরেছি তা সত্যি।“
● নাগরিক জীবনযাত্রা: শরৎচন্দ্র নগরজীবনের একটা অস্বাভাবিক জীবন যাপনকে তিনি তুলে ধরেছেন বেশ হাস্যকৌতুকের রস মাখিয়ে।
নতুনদার কাহিনীতে নতুনদার সাজ পোশাক দেখে তিনি ব্যঙ্গের হাসিতে বলেছেন- “চাঁদের আলোকে তাহাকে দেখিয়া ভয় পাইয়া গেলাম। কলকাতার বাবু- অর্থাৎ ভয়ংকর বাবু। —-পশ্চিমের শীতের বিরুদ্ধে সতর্কতার অন্ত নাই।” নতুনদার আচার ব্যবহারে তীব্র শাণিত ভাষায় যেন সমগ্র নাগরিক সমাজকে বর্ণনা করেছেন- “উপলক্ষ্য যে আসল বস্তুটাকেও কেমন করে বহু গুণের অতিক্রম করিয়া যায়, তাহা ঐসব লোকের সংসর্গে না আসিলে এমন করিয়া চোখে পড়ে না।”
● জাতিভেদ প্রথা: উপন্যাস লক্ষিত হয়েছে সমাজের জাত পাত ভেদের তারতম্য। যখন বালকের মৃতদেহ ছোঁয়া বা অস্পৃশ্যতা নিয়ে শ্রীকান্ত অস্বস্তি বোধ করে তখন ইন্দ্রের ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে “মরার কি জাত থেকে রে?” এ যেন সমাজের কাছে ঔপন্যাসিকের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। আরো এক কাহিনী এ প্রসঙ্গে এসে পড়ে এক বৃদ্ধা ব্রাহ্মণী অসুস্থ হয়ে ‘বিলেত ফেরত’ বা ‘এক ঘরে’ একজনের বাড়িতে আশ্রয় নেন ও দেহত্যাগ করে। এর ফলে তার মৃতদেহ কেউ সৎকার করতে সমাজ রাজি নয়। অবশেষে শ্রীকান্ত ও তার দলবল সৎকার করাই সমাজপতিরা তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে প্রায়শ্চিত্তের জন্য। তাই ঔপন্যাসিক ‘শ্রীকান্ত’ ছদ্মবেশে বলেছেন “ইন্দ্র ঐ বয়সে নিজের অন্তরের মধ্যে যে সত্যটির সাক্ষাৎ পাইয়া ছিল, অত বড় সমাজ বড় বড় সমাজপতিরা অতটা প্রাচীন বয়স পর্যন্ত তাহার কোন তথ্যই পাই নাই।” এছাড়াও যে সমস্ত কাহিনী উপন্যাসে আছে জমিদার শ্রেণীর বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ও অন্যদিকে সন্ন্যাসী জীবনযাত্রা, অসুস্থ শ্রীকান্তকে ফেলে চলে যাওয়া রামবাবুর মতো নীচ মানসিকতা, গৌরী তেওয়ারীর মেয়েদের করুন জীবনযাত্রা।এই সমস্ত কাহিনীকে উত্থাপন করে শরৎচন্দ্র তৎকালীন সমাজকে যেমন পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন, তেমনি সমাজের প্রতি তিনি নানা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন।
■ চরিত্রের আঙ্গিকে:
“আত্মকাহিনীর ছলেই হোক বা কোন নায়ককে স্থাপিত করেই হোক সাধারণত এই জাতীয় উপন্যাসের ভিত্তি লেখকের জীবনে ছায়াপাত করে বলে পাঠকদের কাছে এদের একটা পৃথক মূল্য আছে।” (সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়)
উপন্যাসে কাহিনীর যেমন একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে, তেমনি চরিত্রেরও আছে। তাই ঔপন্যাসিক কাহিনীর মাধ্যমে উপন্যাসে সমাজ ব্যবস্থাকে তুলে ধরেন আর সমাজকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য দরকার হয় চরিত্রের। এক কথায়, কাহিনী যদি উপন্যাসের শরীর হয়,তবে চরিত্র তার মন। তাই ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চরিত্রের মাধ্যমে বা চরিত্রের বিশ্লেষণের দ্বারা অথবা চরিত্রের পরিস্ফুটনের তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থাকে পাঠকদের সম্মুখে তুলে ধরেছেন।
●বিত্তবান ও পরোপকারী ইন্দ্রনাথ: গল্প উপন্যাসের চরিত্রের ঠিক যেমন হয় ইন্দ্রনাথের তেমন চরিত্র নয়। বরণ উল্টোটাই বলা যায় – অর্থাৎ লেখক জীবনের অভিজ্ঞতা এমন কিছু চরিত্রের দেখা মিলে যাদের বাস্তব জীবনটাই গল্প উপন্যাসকে ছাড়িয়ে যায়।
মোহিতলাল মজুমদারের ভাষায় -“বালকের মতো ইহার বিশ্বাস, যুবকের মত ইহার বীর্য্য, মহাস্থবিরের মতো ইহার তত্ত্ব জ্ঞান; যেন সকল প্রেম ও সকল শক্তি চির কিশোরের রূপে লীলা করতে নামিয়াছে।”
প্রথম দর্শনেই মারামারির মধ্যে দেবদূতের মতো অপরিচিত শ্রীকান্তকে উদ্ধার করলো সাহসী ইন্দ্রনাথ। সাহসিকতার সঙ্গে পরোপকারীতার একটা অতিরিক্ত রঙ ইন্দ্রকে অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতাই নিয়ে এল। তারপর সেই অবলীলায় সিদ্ধিপাতা চেবানো শ্রীকান্তের প্রথাগত সংস্কারকের সজরে নাড়িয়ে দিল। ইন্দনাথের মাছচুরির নৈশ অভিযান শ্রীকান্তের কাছে প্রাথমিক পর্বে অ্যাডভেঞ্চার বলে মনে হলেও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় – এই মাছ চুরির আড়ালে ইন্দ্রনাথের আর এক বড়ো পরিচয় লুকিয়ে আছে, তা হল তার পরোপকারীতার পরিচয়। অন্নদাদিদির সঙ্গে ইন্দ্রের কোনো সম্পর্ক বা সামাজিক বন্ধন নেই। অথচ এই অনাত্মীয় সম্পর্কের যে আন্তরিকতা, যে অধিকার বোধ, যে পারস্পরিক নির্ভরতা তা সামাজিক যেকোনো সম্বন্ধে দুর্লভ।শাহজীর কাছ থেকে মন্ত্র শেখার একটা স্বার্থবোধ ইন্দ্রের ছিল কিন্তু সে তার নিজের জন্য নয়, মৃত্যুর করালগ্রাস থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারার মহৎ ধর্ম সমস্ত স্বার্থতাকেই তুচ্ছ করে দেয়। ইন্দ্রনাথের এই বিত্তবান পরোপকারীতায় শ্রীকান্তরূপী শরৎচন্দ্র কয়েকটি কথা ফুটিয়ে তুলেছেন – “কতকাল কত সুখ দুঃখের ভিতর দিয়া বার্ধক্যে উপনীত হইয়াছি। কত দেশ প্রান্তর, কত পাহাড়- নদী -পর্বত -বন- জঙ্গল ঘাঁটিয়া, কত প্রকারের মানুষী না দুচোখে পড়ে আছে কিন্তু এত বড় মহাপ্রান্ত আর কখনো দেখিতে পাই নাই।”
● কুলত্যাগিনী পতিব্রতা অন্নদাদিদি: বাংলা সাহিত্যে নারীত্বের প্রাধান্য প্রাচীন ও মধ্যযুগে যেমন দেখা যায় বঙ্কিমচন্দ্রও নারীত্বের আড়ালে সতীত্বের ধর্মনীতি র জয়গান করেছেন। সামাজিকতার কঠোরশৃঙ্খলে হৃদয়ঘটিত কোনো জিঙ্গাসা শিল্পী বঙ্কিমচন্দ্র উত্থাপন করলেও পতিধর্মের সংস্কারে ফিরে না এসে কোনো উপায় নেই। শ্রীকান্তের স্বীকারোক্তিতে স্পষ্ট অন্নদাদিদি কিভাবে লেখকের মনে দাগ কেটেছিলেন-
“জীবনে এমনসব শুভ মুহূর্ত অনেকবার আসে না। একবার যদি আসে, সে সমস্ত চেতনার ওপর এমন গভীর একটা ছাপ মারিয়া দিয়া যায় যে, সেই ছাঁচেই সমস্ত পরবর্তী জীবন গড়িয়া উঠিতে থাকে। আমার তাই বোধ হয়, স্ত্রী লোককে কখনো আমি ছোট করিয়া দেখিতে পারিলাম না।” অন্নদা দিদি এমন এক জীবনকে বেছে নিয়েছেন। যেখানে সামাজিক সহানুভূতি প্রত্যাশার কোনো সুযোগও ছিলনা। আর দিদিও জীবন ধর্মের এমন এক আত্মমর্যাদার গন্ডী রচনা নিয়েছেন যেখানে সহানুভূতি প্রত্যাশার বাঙালিপনা থাকতেই পারে না। শাহজীর আঘাতে অচৈতন্য দিদি চৈতন্য ফিরে পেয়ে শাহজীর হাতের বাঁধন খুলে দিলে ইন্দ্র অভিমান করে অন্নদাদিদিকে অনেক কথা শুনিয়েছে এমনকি তার কুলত্যাগকেও কটাক্ষ করেছে কিন্তু অন্নদাদিদি নিরুত্তর থেকেছে। সামাজিকতার পাথর ঠেলতে ঠেলতে, অপবাদ কলঙ্কের আঘাত সহ্য করতে করতে তিনি শিখে গেছেন কিভাবে ক্ষত বিক্ষত হয়েও নিরুত্তর থাকতে হয়। অন্নদাদিদির শাহজীর প্রতি ভালোবাসা, তার দায় দায়িত্ব বহনের কর্তব্যবোধ কোনো পতিত্বের সংস্কার মাত্র নয়। তাই শাহজীর মৃত্যুর পর-“— তিনি হাত দিয়া অত্যন্ত সন্তর্পণে মুখাবরন উন্মোচন করিয়া গভীর স্নেহে তাহার সুনীল ওষ্ঠাধর স্পর্শ করিয়া বলিলেন,যাক, ভালোই হলো ইন্দ্রনাথ। ভগবানকে আমি এতটুকু দোষ দিই না।” অপরদিকে দেখা যায়-” ওরে পাগল, যে আমাকে আটকে রাখবে সে আমার নিজেরই ধর্ম।” শরৎচন্দ্র নারী মনের মননে স্পষ্ট করেছেন, নারী মন আপন ভালোবাসায় গড়ে তোলে নিজেরই এক ধর্ম, সেই ধর্ম থেকে তাদের বিচ্যুত করা যায় না। কিন্তু এতকিছু গুণ থাকা সত্ত্বেও সে সমাজে কুলত্যাগিনী অসতী কারন সে ছদ্মবেশী শাহজীর সাথে বেড়িয়ে এসেছিল। তার শ্রীকান্ত রূপী শরৎচন্দ্র প্রশ্ন করেছেন- “কিসের জন্য এতবড় সতীর কপালে অসতীর গভীর কালো ছাপ মারিয়া চিরদিনের জন্য তাঁকে তুমি সংসারে নির্বাসিত করিয়া দিলে?”
● স্বার্থপর রামবাবুর পরিবার: শরৎচন্দ্র উপন্যাসে যেমন মহৎ ব্যক্তিত্বের উল্লেখ করেছেন, তেমনি একশ্রেনীর স্বার্থপর মানুষের কথা তুলে ধরেছেন, এই সব চরিত্রের একমাত্র প্রতিনিধি রামবাবু। শ্রীকান্ত যখন সন্ন্যাসী ভবঘুরে জীবনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখন রামবাবু নামক এই ব্যক্তি সাথে তার পরিচয়। যখন ছোট বাঘিয়া অঞ্চলে বসন্ত মহামারী রূপে ধরা দিল, তখন শ্রীকান্ত এদের পরিত্রান কর্তা হয়ে রামবাবুর সংসারে আশ্রয় পেলো। সারাদিন রাত অসুস্থের সেবা করে যখন শ্রীকান্ত নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লো, তখন এই স্বার্থান্বেষী রামবাবু পরিবার নিয়ে শ্রীকান্ত কে মৃত্যুর মুখে ফেলে পালিয়ে গেলো। তাই শ্রীকান্ত রুপী শরৎচন্দ্র রামবাবুর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন-“তাঁহার স্বভাব আমি জানি – গোপনে তিনি যে সকল সৎকার্য করিয়াছেন, তাহার প্রকাশ্যে উল্লেখ করিলে তিনি বিনয়ে সংকুচিত হইয়া পড়িবেন।”
● অসবর্ণবিবাহের স্বীকার গৌরী তিওয়ারির মেয়ে: শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে নারীরা যে সমস্ত সামাজিক প্রথার মাধ্যমে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অসমবর্ণের মধ্যে বিবাহ। শরৎচন্দ্র শ্রীকান্ত উপন্যাসে সমাজের সেই কলুষিত দিক আর তার চরম পরিণতির ছবি তুলে ধরেছে গৌরী তিওয়ারীর মেয়ের মধ্য দিয়ে। শ্রীকান্তের উক্তিতে,“দশ এগারো মেয়ের চোখে এমন করুণ, এমন উদাস চাহনি, আমি আর কখনো দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না।” সন্ন্যাসী শ্রীকান্ত ভিক্ষা করতে এসে গৌরী তেওয়ারীর মেয়েদের দুঃখ ভরা জীবনের কথা শুনে ও দেখে বিস্মৃত হয়েছেন। শুধুমাত্র স্বগোত্রে পাত্রস্থ করারা জন্য এমন জায়গায় তার মেয়েদের বিবাহ দিয়েছিল যেখানে তারা কোনোদিন খবর নিতে পারত না তারা কেমন আছে, এমনকি এটাও ভেবে দেখত না যে তারা অন্য পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবে কিনা। অবশেষে এই সমস্ত হতভাগীদের কপালে জুটত অত্যাচার বা যে এই অত্যাচার সহ্য করতে পারতনা তার শেষ পরিনতি আত্নহত্যা। তাই শ্রীকান্তর বয়ানে শরৎচন্দ্র সমাজের প্রতি তীব্র কটাক্ষ করেছেন, “যে সমাজ এই দুইটি ক্ষুদ্র বালিকার জন্য স্থান করিয়া দিতে পারে নাই, যে সমাজ আপনাকে এতটুকু প্রসারিত করার শক্তি রাখে না। সে পঙ্গু আড়ষ্ট সমাজের জন্য মনের মধ্যে কিছু মাত্র অনুভব করিতে পারিলাম না।”
● কুমারজীর বিলাস বহুলজীবন: যেখানে গ্রামীন সমাজে সাধারন মানুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সাধ্যসাধনা করে দুমুঠো অন্নের জন্য। আবার কিছু মানুষকে পাওয়া যায় যারা অর্থের বলে বলীয়ান হয়ে সেই অর্থের অপচয় করে আমোদ প্রমোদের মধ্যে নিজেদের ডুবিয়ে রাখে, এই সম্প্রদায়ের মধ্য আমরা কুমারজীকে ফেলতে পারি। আর তৎকালীন বিত্তবান মানুষদের বিনোদনের বিষয় ছিল শিকার ও বাইজী নাচ সহযোগে মদ্যপান। শ্রীকান্ত তাই অনেকটা ব্যঙ্গের ছলে বলেছেন, “রাজার ছেলেদের স্মৃতি শক্তি কম।” কুমারজী শিকারের জন্য বেড়িয়েছেন, আর সেই উদ্দেশ্য আমোদের জন্য এনেছেন বাঈজীকে। শ্রীকান্ত বলেছেন, “এইখানে রাজকুমার বিবেচনা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন,—। বাঈজী সুশ্রী, অতিশয় সুকন্ঠ এবং গান গাহিতে জানে।”
● বাঈজী হয়েও রাজলক্ষ্মীর মাতৃত্ব ও পরোপকারিতা: লেখক শরৎচন্দ্র নারী মনের এক স্বধর্ম আবিষ্কার করেছিলেন। শ্রীকান্ত উপন্যাসের রাজলক্ষ্মী তাদের মধ্যে অন্যতম। জীবনকে জয় করার অন্যতম শক্তি প্রেম। উপন্যাসে প্রেমিকা রাজলক্ষ্মীর পরিচয় যেমন পাওয়া যায়, তেমনি তার মাতৃহৃদয় ও পরোপকারীতার পরিচয়ও পাওয়া যায়। শ্রীকান্ত এতদিন রাজলক্ষ্মীকে দেখে এসেছিল প্রেমিকা রূপে। কিন্তু অসুস্থ শ্রীকান্ত বঙ্কুর মা রাজলক্ষ্মীকে দেখে। যে একদিন সর্বস্ব দিয়ে তাকে বেঁধে রাখতে চেয়েছিল, সেই নারীই সেবা-শূশ্রুষায় অভিন্ন থাকলেও শ্রীকান্তকে আর আগের মতো বঁধে রাখতে জোর করে না। কারণ রাজলক্ষ্মীর মাতৃধর্ম তাকে বাঁধা দিয়েছে। যে জীবন ত্যাগ করে সে এসেছে সেই বাঈজী পিয়ারীর নাম করায় লজ্জিত রাজলক্ষ্মী বর্ষীয়সী প্রবীনার মতো গাম্ভীর্য নিয়ে জানিয়েছে – “ছেলেপিলেদের সামনে আর আমাকে ও বলেডেকো না।” মাতৃত্বের সম্ভ্রম লজ্জায় নারীর আর এক মূর্তি ফুটে ওঠে –
“মনে মনে বললুম, তুই ছেলে তোর কাছে সেকথা আর কি বলবো বাবা।“
এছাড়াও আট দশজন ছেলের পড়ার খরচ, শীতকালে অভাবী মানুষদের কাপড়,কম্বল দান করা, সাধারন মানুষের জন্য নিজের টাকা দিয়ে পুকুর তৈরি করে দেওয়া রাজলক্ষ্মীর পরোপকারীতার পরিচয় মেলে। সমাজের বিত্তবান মানুষেরা, সমাজেরা মাথারা যেখানে বিনোদনে বা কঠোর নিয়ম নিষ্ঠায় মত্ত সেখানে সমাজের সর্বাপেক্ষা কলুষিত স্তরের অধিবাসী হয়েও আপন ব্যক্তিত্বের মহিমায় উজ্জ্বল – কি মাতৃত্বে কি পরোপচিকীর্ষায়।
বঙ্কিমচন্দ্র পরবর্তী বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের শুষ্কপ্রায় স্রোতহীন ধারাকে যিনি বহিঃসমুদ্রের স্রোত গতী দান করেছিলেন, নতুন ভাবের উত্তেজনায় তার মধ্যে নবজীবনের সঞ্চার করেছিলেন তিনি আর কেউ নন ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি সমস্যা জীর্ণ গ্রামীন সমাজ এবং সাধারন মধ্যবিত্ত ও বিত্তহীন মানুষদের স্নেহ-প্রেম, সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার কথা তাঁর উপন্যাসে প্রকাশ করে ‘দরদী’ মনেরই পরিচয় দেন। এমনকি তিনি অমর কথাশিল্পী বঞ্চিত, লাঞ্ছিত ও অবহেলিত সমাজের ‘সংসারে যারা শুধু দিলে পেলেনা কিছুই’ তাদের জীবনের সার্থক রূপকার তিনি। তিনি বাংলা দেশের নিতান্ত সাধারন নরনারীর মলিন ও তুচ্ছ জীবনকেই শ্রীকান্ত উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। তবে এক্ষেত্রে তিনি বাস্তব জীবনকে গ্রহন করে কৌশলে তার সঙ্গে রোমান্সের অদ্ভুত মিল ঘটিয়েছেন, যাতে করে ঘটনা ও কাহিনি পাঠক সমাজের কাছে আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে। সমাজের মধ্য অন্ধকারকে তুলে ধরার জন্যই তিনি মূলত কলম ধরেছিলেন। তাই তাঁর ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে সমাজের মর্ম ও গভীরে নানা সমস্যা ও প্রশ্নের অবতারনা ঘটলেও উপন্যাসে তার সমাধান বর্নিত হয়নি। এই বিষয়ে অনেকে তাঁকে হুইটম্যান ও ডস্টয়ভস্কির সাথে তুলনা করেন। শরৎচন্দ্র এর ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটি সাহিত্য সৃষ্টির ধারায় নানান দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য। এই উপন্যাসের মাধ্যমেই তিনি আধুনিক বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের কাহিনী বাঙালির সীমিত জীবন চেতনার এক সীমাহীন মুক্ত জীবনের স্বাদ দিয়েছেন।
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “আমাদের স্কুল-কলেজ-অফিসের-লৌহ নিগড়-বদ্ধ, রোগ-শোক জর্জরিত, দলাদলি-বিরোধ-কন্যাদায় বিড়ম্বিত বাঙালি জীবনের প্রান্ত সীমায় যে বিচিত্র রস ভোগের এত প্রচুর অবসর আছে, দুসাহসিকতার এত ব্যাকুল প্রবল আকর্ষন আছে, সুপর্যবেক্ষন ও সমালোচনার এরূপ প্রবল বিশাল, রসদ মজুত আছে, তাহা আমাদের কল্পনাতেও আসেনা।এই কল্পনাতীত বিচিত্র সৌন্দর্য ‘শ্রীকান্ত’ আমাদের মুগ্ধ নয়নের সম্মুখে আনিয়া ধরিয়াছে এবং মুক্ত হস্তে আমাদের পাতে পরিবেশন করিয়াছে।”