পুতুল নাচের ইতিকথা – আধুনিকতার লক্ষ্মণ
সাহিত্যে আধুনিকতার পরিচয় প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – আধুনিকতা “সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে”। তবে আধুনিকতার স্বরূপ বিচার প্রসঙ্গে সময়কে যতই অস্বীকার করতে চাই না কেন, আধুনিকতার চেতনার একটি সময় আশ্রিত বিবর্তনধর্মী রূপ আছে। বাংলা কথাসাহিত্যে ‘আধুনিকতা’ এই সময় নির্ভর বিবর্তনের পথ বেয়ে অগ্রসর হয়েছে। পরবর্তীকালে কল্লোল লেখক গোষ্ঠী বিশেষভাবে আধুনিকতার এক প্রবল উদ্দীপনা ও উত্তেজনা সঞ্চার করেছিল সমকালীন বাংলা সাহিত্যে। ‘আধুনিকতা’র এই ধারাবাহী ঐতিহ্যের মধ্যে দাঁড়িয়েও মানিক এক উন্নতশীর্ষ অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব।
আধুনিক কথাসাহিত্যিকের দৃষ্টি যে মূলত বিজ্ঞানদৃষ্টি, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি’, যার প্রধান লক্ষ্মণ কৌতূহল – জগৎ ও জীবন বিষয়ে ব্যক্তিসম্পর্ক – নিরপেক্ষ কৌতূহল ও সুতীব্র জিজ্ঞাসা। দৃষ্টিভঙ্গীর এই স্বাতন্ত্রের তথা নূতনত্বের লক্ষ্মণই এই – “ফ্রেশ ওয়েস অফ লুকিং অ্যাট ম্যানস্ পজিশন অ্যান্ড ফানশন ইন দ্য ইউনিভার্স” (fresh ways of looking at man’s position and function in the universe”)। আর এই অভিজ্ঞানেই আধুনিকতার স্বরূপ চিহ্নিত। এবং প্রকৃতপক্ষে আধুনিকতার এই সব মৌলিক লক্ষ্মণের প্রতিটিই এই মোহমুক্ত তন্নিষৃঠ এবং দু্র্মর জিজ্ঞাসু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি – সবই মানিকের সাহিত্যসৃষ্টির একেবারে আদিপর্যায় থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মানিকের জীবন সম্পর্কিত দৃষ্টির স্বাতন্ত্র্য সন্ধান করতে গিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র মানিকর রচনায় ‘জীবনের প্রতিচ্ছবি’কে বাঁকা বলে চিহ্নিত করেছিলেন। বস্তুত দৃষ্টির এই জটিল ‘বক্র’তার লক্ষ্মণই জগদীশ গুপ্তের মতো মানিকেরও জীবনচেতনার আধুনিকতার অন্যতম প্রধান ভিত্তি। সেই লক্ষ্মণগুলিই আবার রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘শাশ্বতভাবে আধুনিক’।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যান্য অনেক উপন্যাসের মতো ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় আধুনিকতার লক্ষ্মণ পরিস্ফুট হয়েছে। তবে, আধুনিকতার নানা স্বরূপ লক্ষ্মণ ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র আগে একালের বাংলা উপন্যাসে আত্মপ্রকাশ করেছে – রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ থেকে ‘অন্তঃশীলা’র (১৯৩৫) স্রষ্টা ধূর্জটিপ্রসাদ পর্যন্ত বিভিন্ন লেখকের রচনায় তার সাক্ষ্য মিলবে। বাংলা উপন্যাসে আধুনিক জটিল জীবন জিজ্ঞাসার সেই বহমান ধারায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ এক গূঢ় তরঙ্গবেগ সঞ্চার করেছে। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় আধুনিক জটিল জীবনবোধের যে প্রতিফলন ঘটেছে বলাবাহুল্য তার অনেকটাই উপন্যাসের নায়ক শশী চরিত্রের দর্পণে। এদিক থেকে ‘চতুরঙ্গ’ এর নায়ক শচীশ বা ‘অন্তঃশীলা’র খগেনবাবুর সঙ্গে শশীর একটা ভাবসাদৃশ্য আছে হয়তো তবু বাংলা উপন্যাসে আধুনিক জীবনভাবনা বিন্যাসের দিক থেকে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র নায়ক এক অনন্য চরিত্র সন্দেহ নেই। শশী একদিকে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, অন্যদিকে তার বিজ্ঞানমনস্ক মনে হারুর মৃত্যুরহস্য, যাদবের সূর্যসিদ্ধান্তের প্রবল ঘোষণার মধ্যে মানসস্বীকৃতি –
“বিশ্বাস হয় না তবু শশীর মনের আড়ালে লুকানো গ্রাম্য কুসংস্কার নাড়া খাইয়াছে।”
শশীর জীবনের পরকীয় প্রেমের দ্বন্দ্বকে ঔপন্যাসিক আলো ছায়ারমধ্যে রেখে প্রকাশ করেছেন। শশী কুসুমের মনস্তাত্তিক দ্বন্দ্বকে লেখক আধুনিক মন্ডনকলায় পরিবেশন করেছেন। শহর থেকে পাশ করা শশীর মধ্যে সর্বদা সামাজিক সত্তা এবং অহং সত্তার দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে সে হারিয়ে ফেলল তার প্রেমাস্পদকে। এই ট্রাজেডি শশীর জীবনে যেভাবে নেমে আসে তাকে লেখক আধুনিক রীতির মাধ্যমে প্রকাশ করেছে – “নিজের মন কি মানুষ সবসময় বুঝতে পারে…?”
শশী উপলব্ধি করে –
“এক একটা ঘটনা চাবির মতো মনের এক একটা দুয়ার খুলিয়া দেয়। যে দুয়ার ছিল বলিয়াও মানুষ জানিত না।”
শশীর চরিত্রের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আত্ম আবিষ্কার প্রাধান্য পেয়েছে। এইখানেই লেখকের অস্তিত্বগত ব্যাখ্যা যা তাঁকে আধুনিক ঔপন্যাসিকে পরিণত করেছে।
নায়কের মননধর্মী জীবন অন্বেষণ তথা আত্মসন্ধান কথাসাহিত্যে আধুনিকতার অন্যতম লক্ষ্মণ। এই অন্বেষণ শশীকে নিয়ে গেছে জীবন সম্বন্ধে এক গভীর নিষ্ফলতার উপলব্ধিতে। চিকিৎসক হয়েও যখন সে সর্বদা রোগীকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি, নিজের বোন বিন্দুকে মদের নেশা ও অস্বাভাবিক জীবনের প্রতি আসক্তি থেকে সরিয়ে আনতে পারেনি বরং আবার সেই জীবনের দিকে ঠেলে দিতে বাধ্য হয়েছে। এবং সর্বোপরি কুসুমের সঙ্গে নিজের গোপন দুর্মর প্রণয়সম্পর্কের বিপর্যয় রোধ করতে পারেনি – তখন তার দ্বন্দ্ব ক্ষুব্ধ আলোড়িত সত্তায় নিরর্থক অস্তিত্বের যে গূঢ় সংকট, যে বিচ্ছিন্নতাবোধ, তার মধ্যেই আভাসিত আধুনিক জীবনদৃষ্টি। ‘দিবারাত্রির কাব্য’ এর নায়ক হেরম্ব এবং ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র নায়ক শশী – দুই লেখকের আধুনিক জীবনদৃষ্টি সম্ভব চরিত্র।
কথাসাহিত্যে আধুনিকতার যে সব উপাদানকে আশ্রয় করে প্রকাশ পায় তার অন্যতম প্রধান লক্ষ্মণ হল বাস্তবতা। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় রোমান্টিক উপাদানের অস্তিত্ব মেনে নিয়েও বলা চলে কাহিনি, চরিত্র, পরিবেশ – একান্ত বাস্তব নির্ভর। যে সব চরিত্রের মধ্যে রোমান্টিক প্রবণতা আছেতারা ব্যক্তি হিসাবে ব্যক্তি চরিত্রের কার্যকারণ সম্পর্ক ও সম্ভাব্যতার বিচারে নিঃসংশয়ে পাঠকের সীমা লঙ্ঘন করে না – কুসুম, কুমুদ ও মতি তার প্রমাণ।
অন্যান্য চরিত্রের প্রায় প্রতিটিই – গোপাল, সেনদিদি, যামিনী কবিরাজ, পরাণ ও গাওদিয়া গ্রামের অন্যান্য মানুষ সকলেই তাদের সীমাবদ্ধ জীবনের দুঃখ সুখে আকাঙ্ক্ষায় ও আত্মবঞ্চনায় একান্ত বাস্তব। যাদব পন্ডিতের অলৌকিক মৃত্যুর ঘটনাটি যুক্তিবাদী বিজ্ঞানের ছাত্র শশীর দর্পণে প্রতিফলিত হবার ফলে তা আমাদের বাস্তবতাবোধকে গভীরভাবে আশ্বস্ত করে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে পরিচিত জগতের বাস্তব রূপকে স্বীকার করেও তার উপর যেন অন্যতর এক অধিবাস্তবতার বা ‘সুপার রিয়েলিটির’ সূক্ষ আবরণ ছড়িয়ে দিতে চান – যা জীবনের গভীর রোমান্টিক চেতনাকে অস্বীকার করে না, সূক্ষতর অধ্যাত্ম অনুভবকে উপেক্ষা করে না, বরং উপন্যাস পাঠের শেষে পাঠকচিত্তে এইসব কিছুর সম্বন্বয়ে এমন এক সংবেদন জাগে, যা জীবন সম্পর্কে এক গভীরতর বাস্তবতাই প্রতীতি, যে বাস্তবতাকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে গেলে –
“মানুষ আপন অন্তর থেকে অব্যবহিতভাবে স্বীকার করতে বাধ্য। তর্কের দ্বারা নয়, প্রমাণের দ্বারা নয়, একান্ত উপলব্ধির দ্বারা।” (সাহিত্যের পথে)
বাস্তব চিত্রের প্রসঙ্গে এসেছে প্রতীকের প্রয়োগ – পুতুলের। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় – নিয়তি উপন্যাসে কখনো ব্যক্তি কখনো কোনো ঘটনার ওপর আপতিত হয়েছে। ব্যক্তি পরাজয়ের মধ্য দিয়ে নিয়তি তার শক্তিমত্তার পরিচয় রেখেছে। স্বাভাবিকভাবেই কাছাকাছি চলে এসেছে মৃত্যু ও নিয়তি, অত্যন্ত তাৎপর্যময়ভাবে উভয়ের প্রতীক হিসাবে ‘পুতুল’কে ব্যবহার করেছেন ঔপন্যাসিক। সিন্ধুর খেলার পুতুলেরা সার দিয়ে ঘুমোচ্ছে শশীর খাটের তলায়, খুকির ক্রীড়াভূমি থেকে বয়স্কের লীলাভূমি পর্যন্ত তার বিস্তৃতি – বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না পাঠকের। আবার, কুসুমের বিস্ময়কর পরিবর্তন শশীকে পুত্তলিকায় পরিণত করেছে। মতির অত্যাশ্চর্য ভালোবাসার নিগড়ে বাঁধা জীবন মতির পুতুল সত্তার সামনে দাঁড় করিয়েছে জয়াকে। যাদব পন্ডিত সকলের আচরণের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকেই যেন পুতুলে পরিণত করেছে নিজের জীবনের বিনিময়ে। অতঃপর লেখকের ঘোষণা –
“সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর এক, চিরকাল এমনই দেখে এসেছি ডাক্তারবাবু। পুতুল বই তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।”
আসলে দূরদর্শী মানিক সমগ্র উপন্যাসে যে প্যাটার্ন বুনেছেন তাতে দেখা যায় মানুষের সমস্ত প্রয়াস নিষ্ক্রিয়তায় গিয়ে পৌঁছায়, ব্যর্থ হয়। কেউই নিজের জীবনকে নিজের অভিপ্রায় মতো গড়ে তুলতে পারেনি। কিন্তু এর জন্য দায়ী কে ? আপাতভাবে সবকিছুর দায় নিয়তি, সবকিছু ‘অদৃষ্টের লেখন’ বলে মনে হলেও তা লেখকের কলমের মুন্সিয়ানা মাত্র। উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা মুখ্যত নিজের মনের গঠনের কারণে নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতা ডেকে এনেছে, আর গৌণত অন্যেরা সাহায্য করেছে তাদের ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিতে। শশীর অনুভবে এই অমোঘ সত্যের স্বরূপ প্রকাশ করে লেখক বলেছেন –
“জীবনকে শ্রদ্ধা না করিলে জীবন আনন্দ দেয় না। শ্রদ্ধার সঙ্গে আনন্দের এই বিনিময়। জীবনদেবতার এই রীতি।”
সকল আধুনিক কথাশিল্পীর মতো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাতেও আধুনিকতার প্রকাশ ঘটেছে দুই দিক থেকেই – উপকরণ ও দৃষ্টিভঙ্গী। তবে, মানিকের ক্ষেত্রে ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক উপাদান এবং মার্কসীয় বাস্তবতার গুরুত্বকে স্বীকার করেও বলা যায় মানিকের যথার্থ আধুনিকতা তাঁর জীবনসংক্রান্ত মৌল দৃষ্টিভঙ্গীতে এবং সেই দৃষ্টির বিন্যাসের উপযোগী আধুনিক শিল্পরীতির প্রয়োগে। বোদলেয়র বা ডস্টয়ভস্কির যে আধুনিকতা – তা নিছক তাঁদের বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল নয় – তা মূলত জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাঁদের প্রগাঢ় তীব্র আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য। বিদেশী দুই মহান স্রষ্টার মতো মানিকের চেতনাকেও ব্যক্তিজীবনের সুরাসক্তি, দূরারোগ্য ব্যধি প্রভৃতি যন্ত্রণাদায়ক নেতিধর্মী উপাদান করে তুলেছিল তীব্রভাবে আত্মসচেতন এবং তাঁর চারপাশের জীবনসম্পর্কে সূচিমুখ যন্ত্রণাবিদ্ধ তীক্ষ্ণতায় সংশয়ী ও জিজ্ঞাসু। ঠেলে দিয়েছিল প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থা ও প্রথার বিরুদ্ধে অনন্য স্বকীয়তায় এক বেপরোয়া নির্ভীক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণের পথে। আর এইসব লক্ষ্মণ চিহ্নিত পথেরই তো আরেক নাম আধুনিকতা। যে আধুনিকতার বহুবিচিত্র শিল্পিত লক্ষ্মণ ছড়িয়ে আছে তাঁর ‘প্রাক মার্কসিস্ট’ পর্বের গল্প উপন্যাসে – যেখানে রূপায়িত মধ্যবিত্তের ভাঙাচোরা কীটদষ্ট প্রায় বিধ্বস্ত জগৎকে আশ্রয় করে। আর বিপন্ন মানুষের সুষ্ঠভাবে বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণে মানিকের মনের ঐকান্তিক আর্তি তাঁকে দিবারাত্রির কাব্য থেকে পুতুল নাচ ও পদ্মা নদীর জগৎ পেরিয়ে নিয়ে এল শ্রেণীসচেতন অর্থনৈতিক সংগ্রামের জগতে।