বিষয় – ডেঙ্গুর প্রকোপ ও প্রতিকার প্রবন্ধ রচনা

কলমে : অনন্যা সাহা, বি.এ ( বাংলা ), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়


ভূমিকা :
    বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে সবরকম রোগের পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগটিও বিশেষ ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এই কারণ বশত ডেঙ্গুকে রুখতে এর রোধের কর্মসূচি গ্রহণও বিশেষ প্রয়োজন সাপেক্ষ হয়ে পরেছে। তাই আমাদের পশ্চিমবঙ্গ সরকার নির্মিত,রাজ্য নগর উন্নয়ন সংস্থা ডেঙ্গু প্রতিরোধে কি করা উচিত ও কি করা উচিত নয় এর এক নির্দিষ্ট তালিকা রাজ্যের কোণে কোণে প্রেরণ করার উদ্যোগ, সদিচ্ছা সহকারে গ্রহণ করেছে। সাম্প্রতিক বিজ্ঞানক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মহলের ব্যক্তিরা আশঙ্কা করেছিলেন বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং নানান ধরণের প্রকৃতিগত অসংগতির জন্য এ বছরে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ বিশেষ হারে বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলতো এই আশঙ্কার উপর ভিত্তি করে সংক্রমণের হার কমাতে সঠিক সময়ে,সঠিক কর্মসূচি গ্রহণ ভীষণ প্রয়োজন। এই ডেঙ্গুর হাত থেকে রক্ষার্থে যে বিষয়ে সর্বপ্রথম নজর দিতে হবে তা হলো এডিস মশাদের আঁতুড় ঘরকে ধ্বংস করা। এই কাজ করলেই প্রথমিক ভাবে ডেঙ্গু রোগ থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব।
মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ডেঙ্গু রোগটি সারা বিশ্বের এক ভয়ানক সংক্রমণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং ধীরে ধীরে এশিয়া সহ নানান স্থানে ডেঙ্গু নিজের থাবা বিস্তার করতে থাকে। প্রসঙ্গত ১৭৭৯ সালে সর্বপ্রথম ডেঙ্গু রোগটির উল্লেখ মেলে।
পরে বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধে ডেঙ্গু রোগটির যাবতীয় তথ্য সাধারণের কাছে পৌঁছতে আরম্ভ করে। বলাবাহুল্য পূর্বকাল থেকে আজকের সময় পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগটির সংজ্ঞা জানা গেলেও এর যথার্থ প্রতিষেধক আজ পর্যন্ত নির্মিত হয়নি এই কারণে সাবধানতা অবলম্বনই হলো ডেঙ্গু প্রতিরোধের মোক্ষম উপায়।

ডেঙ্গু রোগের বিস্তার কীভাবে ঘটে :
     যে এডিস মশার দ্বারা এই রোগের বিস্তার হয় সেই মশা আকারে বেশ বড়ো এবং তার গায়ে ডোরাকাটা দাগ থাকে। ফলত এমন ধরণের মশা দেখলেই তার থেকে নিস্তার পাওয়া অবশ্য করণীয়। এই মশা গুলি বর্ষাকালের পরবর্তী সময়ে যেকোনো জমা জল যুক্ত এলাকায় নিজেদের বংশবিস্তার করে। এই মশা গুলির জন্মানোর জন্য জলের প্রয়োজন তাই খরা তথা রোদ গরমের সময়ে এই মশার উপদ্রপ বেশ কমই থাকে। এডিস মশা হলো ডেঙ্গু নামক জীবাণুটির বাহক। এই কারণে সব এডিস মশা কামড়ালেই যে ডেঙ্গু হবে তা নয় বরং যে এডিস মশা গুলি ডেঙ্গু জ্বরের বাহক তারা দংশন করলেই একমাত্র এই রোগ হওয়া সম্ভব। এই মশা কামড়ায় সকালবেলা এটিই এই মশাদের মোক্ষম সময়। এছাড়া যে মানুষকে ডেঙ্গু জীবাণুবাহী মশা কামড়ায় সেই মানুষ চার থেকে ছয় দিনের সময়পর্বের মধ্যেই ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে কোনো ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে এডিস মশা কামড়ালেও সেই মশা ডেঙ্গু রোগ বহনকারী মশায় পরিণত হয়। মূলত এই ভাবেই ডেঙ্গু রোগ ছড়াতে থাকে এক মানুষ থেকে আর এক মানুষের শরীরে।

ডেঙ্গু জ্বর :
ডেঙ্গু ভাইরাসটির বাহক মশা হলো এডিস এলবোপিকটাস ও এডিস ইজিপটাই। এই দুই মশার জাতি স্ত্রী। এই মশা গুলি নিজ দেহে এই ভাইরাসকে বহন করে। এই ভাইরাসটির দ্বারা আক্রান্ত হলে মানুষ এক ধরণের তীব্র জ্বরের শিকার হয় যার নিরাময় করা বেশ কঠিন তাই এই ভাইরাস থেকে সাবধান থাকায় শ্রেয় । প্রসঙ্গত এডিস মশা এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত যেকোনো মানুষ ডেঙ্গু রোগটির সংক্রমক আধার হিসেবে কাজ করে তাই এই দুয়ের থেকে সাবধানতা অবলম্বন বিশেষ প্রযোজ্য।
ডেঙ্গু জ্বর মূলত তিন ধরণের হয়, ক্লাসিকাল ডেঙ্গু, হিমোজেরিক ডেঙ্গু ফিভার এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রম।
ক্লাসিকাল ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে জ্বর ওঠানামা করে এবং রোগীর তীব্র জ্বর আসে। এই জ্বর দুই থেকে সাত দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। অন্যদিকে হিমোজেরিক ডেঙ্গু ফিভারের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বরের স্থায়িত্বের পাশাপাশি আরও কিছু বাড়তি শারীরিক সমস্যা পরিলক্ষিত হয় যেমন – রক্তবমি, চোখ থেকে রক্তক্ষরণ ইত্যাদি।
এছাড়া ডেঙ্গু শক সিনড্রম হলো সব  থেকে বিপদজনক,এই রোগ হলে রোগীর মৃত্যু অব্দি ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
তবে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে, আক্রান্ত ব্যক্তিসকলের মধ্যে আশি শতাংশ রোগী থাকে উপসর্গ বিহীন। সামান্য জ্বর ছাড়া প্রথম দিকে তাদের মধ্যে আর কোনো রকম, কোনো রোগের লক্ষণই দৃষ্টি গোচর হয়না এই কারণ বশত সঠিক সময়ে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সঠিক নিরীক্ষণ বিশেষ প্রয়োজন সাপেক্ষ।

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ :
• উচ্চ তাপমাত্রায় জ্বর আসা।
• মাথায় চাপ তথা মাথায় তীব্র ব্যাথা।
• চোখে তীব্র ব্যাথার অনুভূতি।
• গাঁটে, অস্থি মজ্জা এবং পেশীতে ব্যাথা।
• গ্রন্থি বাহুল্যতা।
• ত্বকের নানান স্থানে ফোঁড়ার উৎপত্তি।
• মাথা ঘোরা ও বমিভাব।
• স্বাভাবিকভাবে শ্বাস গ্রহণে সমস্যা।
• পেটে ব্যাথা।
• তীব্র ভাবে সর্দি ও কাশি হওয়া।
• শারীরিক সমস্যার দরুণ শরীরের প্রস্রাব নিঃসরণের পরিমান বৃদ্ধি আবার প্রস্রাব নিঃসরণের পরিমান হ্রাস ।
• শরীরে রক্ত চাপ ও নারী স্পন্দন অস্বাভাবিক ভাবে কার্যকর হতে থাকা ।

ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা :
বর্তমানে ডেঙ্গু রোগের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা টিকা নেই ফলত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপরেই মূলত নির্ভর করে, এই রোগ হওয়ার পরে,রোগটির মোকাবিলা করা । ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হলে রোগীর প্রচুর বিশ্রামের পাশাপাশি, প্রচুর জল পান করা প্রয়োজন, এবং বাড়াবাড়ি হলে সেলাইন ও দিতে হতে পারে। এছাড়া খাদ্য পথ্যের মধ্যে ভিটামিন সি জাতীয় খাবার থাকা দরকার। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে রোগীকে নানান ধরণের খাদ্য নিয়মিত গ্রহণ করতে হবে এবং প্রাথমিক ভাবে জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটেমল ভক্ষণ করতে হবে। রোগের তীব্রতা যদি বাড়ে তো রোগীকে রক্ত দানও করতে হতে পারে। এই সমস্ত করলে,  মোটামুটি দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে রোগী সেরে উঠবে। এছারা এও ঠিক যে রোগীর রোগ নিরাময়ের সময়পর্ব তার রোগের তীব্রতার উপরেই নির্ভরশীল।

ডেঙ্গু রোধের কিছু উপায় সমূহ :
• যেকোনো খোলা জায়গায় প্লাস্টিকের কাপ, চায়ের ভাঁড়, পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোলা, বোতল ইত্যাদি ফেলা যাবেনা। কারণ এই সব আধার গুলিতে অল্প পরিমানে জল জমলেও মশার প্রদুর্ভাব ঘটবে।
• আন্ডারগ্রাউন্ড জলের রিসার্ভার ও ওভারহেড জলের ট্যাঙ্কির মুখ সর্বদা ঢেখে রাখতে হবে এবং ট্যাঙ্কিতে কোনো প্রকার ফুটো থাকলে তা অতী সত্তর সরিয়ে ফেলতে হবে।
• প্রত্যেকটি এলাকা পরিষ্কার রাখতে হবে প্রয়োজনে পরিষ্কারের জন্য স্থানীয় পৌর কর্তৃপক্ষের সাহায্য গ্রহণ করতে হবে।
• বৃষ্টি হলে ফুলের টবেও যাতে জল না জমে তার দিকে নজর দিতে হবে।
• গৃহস্থে ফুলদানি বা জমা জল যুক্ত পাত্র থাকলে তার জলও নিয়মিত বদলাতে হবে।
• ফ্রিজের ট্রেতেও জল জমলে মশা জন্মাতে পারে সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
ইত্যাদি।
উপরিউক্ত কর্মসূচি পালন করলে মারণ মশার জন্মানোর হার কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব।

উপসংহার :
ডেঙ্গু রোগটিকে যেহেতু কোনোভাবেই নির্মূল করা সম্ভব নয় সেহেতু সঠিক সময় মতন সাবধানতা অবলম্বন করে এ রোগকে রোধ করা হলো আমাদের মূল কাজ। এই রোগ থেকে বাঁচার এক মাত্র উপায় হলো এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধ। এ কাজ করলেই অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রেহায় পাবে। ডেঙ্গু রোগ আগেও ছিল এখনো আছে এবং আমাদের এই রোগকে সাথে নিয়েই পথ চলতে হবে।  রোগটিকে ধ্বংস করা যেহেতু অসাদ্ধ কার্য তাই এই ধ্বংসের পথ ছেড়ে এর থেকে বেঁচে থাকার জন্য কর্মসূচি গ্রহণই হলো বুদ্ধিমানের কাজ।