বিষয় : গণমাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট : ভালো না মন্দ
কলমে : অনন্যা সাহা, বি.এ ( বাংলা ), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
■ ভূমিকা :
যে মাধ্যম দ্বারা মানুষের কাছে অতীব সহজে পৌঁছানো যায় তথা অতীব সহজে গণ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অটুট রাখা যায় তাই হলো গণমাধ্যম। গণমাধ্যম নানা প্রকারের হয় যার মধ্যে বৈদ্যুতিক মাধ্যম এবং মুদ্রিত মাধ্যম হলো অন্যতম। প্রসঙ্গত বর্তমানে এই বৈদ্যুতিক মাধ্যমের মূল কান্ডারী হলো ইন্টারনেট। ইন্টারনেট আসার পরে এই যুগে গণযোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই উন্নতি লাভ করেছে যে, মানুষ ইন্টারনেট বিনে সাধারণত কিছু বোঝেইনা। তাদের কাছে সমস্ত রকম সাইবার সম্পর্কিত কাজের জন্য মূল প্রয়োজনীয় বিষয় হলো ইন্টারনেট। তবে এমন ঘটনার জন্য মনুষই যে সম্পূর্ণ ভাবে দায়ী তা নয়, বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ব্যবসায়িক কর্তৃপক্ষ ইন্টারনেটকে এমন সহজলভ্য করে দিয়েছে যে, সবায় স্বজ্ঞানে সব রকমের কাজের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারকে অত্যাবশ্যক করে তুলেছে যেমন, সামান্য অর্থ আদান প্রদানও আজকাল ইন্টারনেট এর দৌলতেই হয়, যাকে বলে অনলাইন পেমেন্ট।
বলাবাহুল্য প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে, ইন্টারনেট আমাদের কাছে আসে এবং এর আসার পরে মানুষ এর উপযোগিতার প্রতি এমন আসক্ত হয়ে পরে যে, তারা সর্বক্ষেত্রে ধীরে ধীরে ইন্টারনেটকে এক অত্যাবশ্যক চাহিদায় পরিণত করে তোলে। এরই সাথে আসে ইন্টারনেটের বিভিন্ন ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক যে দিক গুলির ফল সময়ের সাথে মানুষকেই ভোগ করতে হয় নানাভাবে।
■ ইন্টারনেট কি :
এই ইন্টারনেট,নেটওয়ার্ক বিষয়টির সাথে অতঃপ্রত ভাবে জড়িত ফলত বলা চলে ইন্টারনেট হলো এমন এক ধরণের নেটওয়ার্কিং সাইট যার সাহায্যে সারা বিশ্বের সাথে অনায়াসেই সংযুক্ত হওয়া সম্ভব। সর্বপ্রথম ১৯৫৯ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কেন্দ্রে ইন্টারনেট এর উদ্ভাবন হয়। প্রথম দিকে মূলত বিভিন্ন আক্রমণ রুখতে, নানা বৈজ্ঞানিক তথ্য সহ নানান ধরণের তথ্য আদান প্রদানের জন্যই ইন্টারনেটের আবিষ্কার করা হয়। প্রথমে এই ইন্টারনেট পরিচিত ছিল ‘মিলনেট’ নামে, পরে এর নাম সময়ের সাপেক্ষে বিবর্তিত হয়। সত্তর এবং আশির দশকে ইন্টারনেটকে অত্যন্ত সাবধানে সরকারি আওতায় অথবা যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের আওতায় ব্যবহার করা হতো তবে আশির দশকের পরে এই ইন্টারনেটকে সাধারণের মধ্যে আনা হয় অর্থাৎ ইন্টারনেট ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের আওতায় আসতে থাকে ফলে মানুষও ইন্টারনেটকে নিজ যাপনের মধ্যে ধীরে ধীরে অন্তর্ভুক্ত করতে থাকে।
পরে সময়ের সাথে ইন্টারনেটে পরিবহনের দায়িত্ব নানান ব্যবসায়িক কর্তৃপক্ষের হাতে চলে যায় এবং তারাই জনসাধারণের মধ্যে ইন্টারনেটকে প্রদান করতে থাকে। পরে এর চাহিদা এতো বাড়তে থাকে যে মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সুবিধা পেতে আগ্রহী হয়ে পরে এবং ইন্টারনেটের বাহুল্যতা ভীষণ পরিমানে দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় আট কোটির উপর বৈদ্যুতিক যন্ত্র যেমন – কম্পিউটার, মোবাইল, ল্যাপটপ ইত্যাদি ইন্টারনেটের আওতাভুক্ত।
■ যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট :
প্রাথমিক ভাবে বলতে গেলে যে বা যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে তারা একাধারে দর্শক শ্রোতা এবং নিয়ন্ত্রণকারী। তারা একদিকে যেমন ইন্টারনেট থেকে নানান বিষয় অনুধাবন করতে পারে তেমনি ইন্টারনেটকে নিজের মতন নিয়ন্ত্রণও করতে পারে অর্থাৎ ইন্টারনেটের যোগাযোগ ব্যবস্থা হলো মূলত দ্বিমুখী। যারা যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে তারা সকলেই, নেট মাধ্যমে একে ওপরের সাথে যুক্ত থাকে ফলে তারা নিজেরদের মধ্যে নৈকট্ট নির্মাণ করতে পারে অতীব সহজেই। প্রসঙ্গত ইন্টারনেট প্লাটফর্মে মানুষ সারফিঙ করে নানান ধরণের বিষয় সম্মন্ধে অবগত হয় এবং সে বিষয় সম্মন্ধে তাদের মতামত প্রকাশ করারও স্থান থাকে।
যেকোনো উন্নত প্রযুক্তি যুক্ত যন্ত্রেই ইন্টারনেট কানেকশন থাকা বর্তমানে বিশেষ প্রয়োজন সাপেক্ষ হয়ে পরেছে কারণ বর্তমানে যেকোনো অফিসিয়াল কার্যাবলীও ইন্টারনেট মাধ্যমেই হয়ে থাকে। মানুষ হলো সুবিধাবাদী এই কারণে তারা যেকোনো সুবিধা যুক্ত বিষয় পেলে তার পিছনেই ছোটে। ইন্টারনেটও এমনি এক অতল সুবিধা যুক্ত বিষয় ফলত মানুষের এর প্রতি আসক্তি যথেষ্ট পরিমানে বেশি। বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও উন্নততর করার পিছনেও এই ইন্টারনেটেরই বিপুল ভূমিকা আছে, ইন্টারনেটের দ্বারা চলা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম হলো এর উৎকৃষ্টতম উদাহরণ। এই প্লাটফর্ম গুলির মাধ্যমেই মানুষ নানান কিছুর সংস্পর্শে আসে যে সংস্পর্শ গুলি তাদের বিশ্বের বৃহৎ সমুদ্রের এক দীর্ঘ যোগাযোগ শৃঙ্খলের সাথে বেঁধে দেয় অনায়াসে।
■ ইন্টারনেট দ্বারা চালিত নানা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম :
আজকাল আমাদের প্রায় সবার হাতেই থাকে স্মার্ট ফোন এবং এই স্মার্ট ফোনের যুগে ইন্টারনেট হলো অপরিহার্য। স্মার্ট ফোনে থাকা নানান এপ্লিকেশান চলে এই ইন্টারনেটের দ্বারাই। সর্বোপরি ইন্টারনেট হলো সব রকমের এপ্লিকেশান চালনার মূল অঙ্গ। ইন্টারনেট বিনে প্রায় সব রকমের এপ্লিকেশানই অকেজো। বলাবাহুল্য এই এপ্লিকেশান গুলিও ইন্টারনেটকে গণমাধ্যমে পরিণত হয়ে অনেক দিক থেকে সাহায্য করেছে। নিম্নে এমনি কিছু জনপ্রিয় গণমাধ্যম সমন্নিত এপ্লিকেশন এর উল্লেখ করা হলো-
• গুগুল : এটি হলো ইন্টারনেট চালিত এমন এক এপ্লিকেশন যার দ্বারা বিশ্বের আনাচে – কানাচের সমস্ত রকম জ্ঞান পাওয়া যায় চোখের মিনিটে। কোনো ব্যক্তি যা কিছু জানতে চায় সেই বিষয়টি গুগুল সাইট-এ গিয়ে টাইপ করলেই অনায়াসে সেই বিষয়ে নানান কিছু তথ্য সামনে চলে আসে।
• ইউটিউব : এইটির মাধ্যমে নানা বিষয় সম্মন্ধিয় ভিডিও কনটেন্ট পাওয়া যায়। ছোট থেকে বড়ো যেকোনো বিষয় নিয়ে কনটেন্ট ক্রিয়েটাররা ভিডিও বানান এমন তা ইউটিউব প্লাটফর্মে পোস্ট করেন যে ভিডিওগুলি অতি সহজে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে যায়।
• হোয়াটস্যাপ : এটি হলো প্রত্যক্ষ ভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনকারী এক ধরণের প্লাটফর্ম। যেকোনো মানুষের ফোন নম্বর দিয়ে নিজেকে রেজিস্টার করে সমস্ত রকমের বিষয়-আসয় এই হোয়াটস্যাপ মাধ্যমে প্রেরণ করতে পারে অনায়াসে।
• পেটিএম : এ হলো আর এক ইন্টারনেট চালিত চমৎকার প্ল্যাটফর্ম এর মাধ্যমে সরাসরি ব্যাংক থেকে যান্ত্রিক মাধ্যমে যেকোনো জায়গায় টাকা পাঠানো সম্ভব।
• স্কাইপ : এর মাধ্যমে নেটের দ্বারা ভিডিও কনফারেন্স সম্পন্ন করা যায়। মানুষ যেকোনো নেটওয়ার্ক যুক্ত স্থানে বসেই স্কাইপ এর মাধ্যমে সরাসরু ভিডিও কল করতে পারে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে।
উপরিউক্ত এপ্লিকেশনগুলি বাদেও সাইবার জগতে আরও নানা রকমের এপ্লিকেশন বর্তমান আছে যেগুলি নানান সমকালীক, রাজনৈতিক, নান্দনিক, শৈল্পিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক, বৌধিক, ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করে জনসংযোগ ঘটায়।
■ গণমাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটের ইতিবাচক দিক :
ইন্টারনেট মানুষের নানা দিক থেকে কাজে লাগে। এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলি করতে ইন্টারনেট ব্যবহার করা অবশ্য প্রয়োজন হয়ে ওঠে। আবার এমনও কাজ আছে না শুধু মাত্র ইন্টারনেটের দ্বারাই হয়, ইন্টারনেট ছাড়া সেই কাজ গুলি সম্পন্ন হয়না। বর্তমানের যেকোনো উন্নত মানের সফটওয়্যার চালানোর জন্য তথা সেই সফটওয়্যারে বিভিন্ন ধরণের কাজ করার জন্য ইন্টারনেট কানেকশন থাকা জরুরি হয়ে পরেছে তাই প্রত্যেক মানুষ নিজের অফিসিয়াল থেকে ব্যক্তিগত নানা কাজ এর মাধ্যমেই করা সুবিধার বলে মনে করে।
নিম্নে ইন্টারনেট সংক্রান্ত কিছু সুবিধার কথা উল্লেখ করা হলো :
•মানুষ অতীব সহজে সারা বিশ্বের খবর এক জায়গায় বসে পেতে পারে।
•এর মাধ্যমে মানুষ নিজ ব্যক্তিগত বক্তব্য পর্যন্ত সাইবার প্লাটফর্মে পেশ করতে পারে।
•মানুষ একে অপরের সাথে অতীব সহজেই যোগাযোগ করতে পারে সে চ্যাট মাধ্যমে হোক বা ভিডিও মাধ্যমে।
•মানুষ নিজের জ্ঞানের ভান্ডার বিভিন্ন ক্ষেত্রের নিরিখে বাড়াতে পারে।
•বিশেষ করে রিসার্চ বা অধ্যয়নের কাজেও প্রাথমিক ভাবে ইন্টারনেট ভীষণ কার্যকরী।
•মানুষ এই ইন্টারনেট মাধ্যমেই অতীব সহজে অর্থ অবধি চালনা করতে পারে।
•সর্বোপরি এই ইন্টারনেটের জন্যই অগুন্তি মানুষ বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের কার্যসূত্রে নিযুক্ত এবং এই কার্যের সুবাদে তারা যথেষ্ট পরিমানে অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম।
■ গণমাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটের নেতিবাচক দিক :
ইন্টারনেটের হাজারো ইতিবাচক দিকের মধ্যে, সব থেকে বড়ো নেতিবাচক দিক হলো এই ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তি। যেকোনো বিষয়ের প্রতি আসক্তি জিনিসটি ভীষণই ভয়ঙ্কর। মানুষের মধ্যে এই আসক্তি কার্যকর হলে যেকোনো ভালো জিনিস খারাপের পর্যায়ে নেমে যেতে বাধ্য। অর্থাৎ কোনো ভালো জিনিসকে ভালো ভাবে সীমার মধ্যে ব্যবহার করা শ্রেয় কিন্তু যখনই জিনিসটির প্রতি আসক্তি জন্ম নেয় তখনি হয় বিপদ, ফলে জিনিসটি যতই ভালো হোকনা কেন তা আসক্ত মানুষটির জন্য নিতান্ত মন্দ বৈ ভালো হয়না। মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এই একই রকমের ঘটনা ঘটে। প্রথমে মানুষ কাজের জন্য ইন্টারনেটকে ব্যবহার করলেও,পরে এই ইন্টারনেট ব্যবহার তাদের কাছে আসক্তি তথা নেশায় পরিণত হয়। বর্তমানে সব রকম বয়সী ব্যক্তিবর্গই এই ইন্টারনেটের প্রতি দৃঢ়ভাবে আসক্ত। তবে শিশু, কিশোর এবং বয়স্কদের মধ্যে আসক্ত হওয়ার প্রবণতা বিশেষ বেশি।
এছাড়াও ইন্টারনেট হলো এক অন্য ধরণের জগৎ যে জগতে পা রাখলে নিজের ব্যক্তিগত কিছুই গোপন থাকেনা, আমাদের অজান্তেই, যেকোনো ছলে ব্যক্তিগত সমস্ত কিছুই অনায়াসে ইন্টারনেটের আওয়াতায় চলে যায়। এই ব্যাপারটি সাধারণ প্রেক্ষাপটে ভীষণ সহজ-সরল হলেও। অনেক অসাধু মানুষ যেকোনো ব্যক্তির এই ব্যক্তিগত বিষয়গুলিকে হস্তগত করে, তা কাজে লাগিয়ে সাইবার ক্রাইমে লিপ্ত হয়ে পরে। যে ক্রাইমের ভুক্তভুগি ব্যক্তিবর্গকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এই ক্রাইমকে এক কথায় বলা হয় হ্যাক।
ইন্টারনেট মানুষকে নানা রকম ভাবে প্রভাবিতও করে যার ফলে গণমাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট বিশেষ বিপদজনক।
■ উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায় ভালো-মন্দ এই দুই-ই সব প্রকারের বিষয়ের ক্ষেত্রেই কার্যকর হয়, ঠিক তেমন ভাবেই ইন্টারনেটও এ-মতো নিয়মের ব্যতিক্রমী নয়। ইন্টারনেট মূলত গণমাধ্যম হিসেবে ভালো-খারাপ এই দুই-এর মিশেলেই কার্যকরী। একদিকে যেমন ইন্টারনেট মানুষকে নানা ভাবে সাহায্যও করে আবার এই ইন্টারনেটই মানুষকে নানা প্রকারে ধ্বংসও করে ফেলতে পারে। তাই ইন্টারনেটের মধ্যে থাকা ভালোর সাথে,মন্দটিকেও বরণ করে এবং নানান খারাপের মাঝেও ভালোটাকে বেছে নিয়েই পথ এগোনো আমাদের অবশ্য করণীয়।