দেশভ্রমণ

অভিজিত ঘোষ, বাঁকুড়া বিশ্ববিদ‍্যালয়


ভূমিকা:-
    দেশ-বিদেশে বিচরণ করার সাধ প্রায় প্রতিটি মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান। সমাজে বসবাস করে সমাজের স্রোতে গা ভাসিয়ে মানুষ তার নিজস্ব কর্তব্যে অটল থাকলেও, আভ্যন্তরীণভাবে সে মুক্ত বাসনার অঙ্গীকারে বরাবর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। মন কেমনের জগৎ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষ অনেক সময় বিভিন্ন জায়গার মুক্তভাবে বিচরণ করে থাকে। এছাড়াও অজানাকে জানার জন্য মনের উৎসাহে এক বিশাল চেতনাপূর্ণ দেশভ্রমণের প্রয়োজনেও নিজেকে নিযুক্ত করে ফেলেন বিভিন্ন মানুষ, যা থেকে জন্ম নেয় দেশভ্রমণের এক প্রবল ইচ্ছা ও বাসনা এবং এই ইচ্ছা বা বাসনাকে পূর্ণ করার জন্যই মানুষ বেরিয়ে পড়ে অজানাকে জানার উদ্দেশ্যে।

প্রাচীনকালের দেশভ্রমণ:-
“থাকবো না আর বদ্ধ ঘরে /  দেখব এবার জগৎটাকে”
           এই বাসনা মনে নিয়ে বহু প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ এই পৃথিবীর পূণ্যভূমিতে বিচরণ করে চলেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সেই প্রাচীনকালের থেকেই মানুষ ভ্রমণের প্রতি আকৃষ্ট। প্রাচীনকালে জলপথে জাহাজ নিয়ে দুঃসাহসিকভাবে দেশ মহাদেশ আবিষ্কারের নেশায় দুঃসাহসিকভাবে সমুদ্রে অভিযান চালিয়েছে বহু মানুষ। মনে অগাধ স্বপ্ন নিয়ে জগৎটাকে ঘুরে দেখার যে বাসনা বহু মানুষের মধ্যে ছিল তাই ইতিহাসের পাতার পোর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামার জলপথে ইউরোপ থেকে ভারতের রাস্তা আবিষ্কারের কাহিনী থেকে বোঝা যায়। এছাড়াও প্রাচীনকালে স্থলপথে ভ্রমণের কাহিনী যে বিরল তাও কিন্তু বলা যায় না। যদিও প্রাচীনকালে স্থলপথে বিচরণ করা মানুষের খুবই কষ্টকর একটা ব্যাপার ছিল, তবুও স্থলপথে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ভ্রমণের কাহিনী কিন্তু অনেক শোনা যায়। আরব্য উপন্যাসের কয়েকটি ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল রেখে দেশ ভ্রমণের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করে যায়।

আধুনিক কালের দেশভ্রমণ:-  
     প্রাচীনকালের দেশভ্রমণ দুর্গম ও দুঃসাহসিক থাকলেও, বর্তমানে দেশ ভ্রমণের কষ্ট বেশ কিছু লাঘব হয়েছে। বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তি ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমগুলির কারণে দেশভ্রমণের প্রতি আকৃষ্টতাও যেমন বেড়েছে মানুষের, তেমনই রেল ব্যবস্থা প্লেন ব্যবস্থা ও বাস ও ট্রামের যাতায়াতের সুবিধার বৃদ্ধির প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে মানুষের ঘুরে দেখার আকৃষ্টতা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের জ্ঞানের পরিধির বিস্তার ঘটেছে। প্রাচীন মনোভাব ও আধুনিক চিন্তাভাবনা মন থেকে মুছে ফেলে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ রঙিন হয়ে উঠেছে দেশভ্রমণ। দেশভ্রমণ যেন নবজীবন পেয়েছে। আর এই নবজীবনের আলোকে আলোকিত হয়ে অত্যাধুনিক মানুষের প্রাণে সাড়া জাগিয়ে তুলেছে দেশভ্রমণ।

দেশ ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা:-   
      সেই প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সভ্যতার ক্রম বিবর্তনের ফলে সমগ্র পৃথিবীজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন ভাষা গোষ্ঠীর মানুষজন। আর এই মানুষজনের বৃদ্ধি থেকেই বিভিন্ন সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের কথা জানার জন্য দেশ ভ্রমণ অত্যন্ত জরুরী। দেশ ভ্রমণের ফলে বিভিন্ন স্থানের মানুষের কথা ও তাদের আচার-আচরণ সম্পর্কে সামগ্রিক জ্ঞান লাভ করা যায়। এছাড়াও দেশ ভ্রমণের মাধ্যমেই জেগে ওঠে সাম্যের মনোভাব যা থেকে একজন মানুষের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সম্ভব হয়ে ওঠে। এই পৃথিবী বড়োই বিচিত্র, আর এই বিচিত্রতার স্বাদ গ্রহণ করতে হলে কেবলমাত্র গ্রন্থ পাঠ করলেই হবে না স্বচক্ষে বিচিত্রপূর্ণ ভূমিতে বিচরণ করে বিচিত্রময় জগতের বিচিত্রতার স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা, তাই প্রত্যেকের দর্শনও হবে আলাদা আলাদা। সুতরাং, বই পড়ে আমরা কেবলমাত্র একজন লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে পারি। নিজের দর্শন ক্ষমতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে পারি না। তাই নিজের দর্শনকে, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানার জন্য এবং নিজেকে জানার জন্য দেশ ভ্রমণ একান্ত প্রয়োজন।

দেশ ভ্রমণের উপায় ও অসুবিধা:-    
       অতীতের দেশ ভ্রমণের তুলনায় বর্তমানে দেশ ভ্রমণ অনেকাংশে সহজলভ্য হলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আজ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দ্বারা মানুষ পুরো বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। অর্থের প্রাচুর্যতা থাকলেই দেশ-বিদেশের ঐতিহাসিক স্থান ও প্রাচীন নিদর্শনগুলি ভ্রমণ করে আসা যায়। কিন্তু এই অর্থ জোগাড় করা প্রতিটি মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনা। তাই তাদের ইচ্ছে গুলোর গলায় শিকল পরিয়ে বেঁধে রাখতে হয়েছে। পুরাতন দিনের মানুষজনেরা তাদের ইচ্ছা মতো যেখানে সেখানে বিচরণ করতে পারতো তাই ইবন বতুতা, হিউয়েন সাং প্রমূর্খ ব্যক্তিবর্গরা দেশ থেকে দেশান্তরে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘোরার বিশেষ সুযোগ ও সুবিধা পেয়েছেন এবং তারা বিভিন্ন মানুষের কাছে সমাদরও পেয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে ভিসা পাসপোর্ট ছাড়া অন্য দেশে বিচরণ করা সম্ভব নয় যার ফলে নিত্যনতুন ইবন বতুতা ও হিউয়েন সাংয়ের জন্মের পথে এক বিশেষ বাধার সূচনা হয়েছে।

দেশভ্রমণের উপকারিতা :-     
   দেশভ্রমণের প্রচুর উপকারিতা রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি হল –
৹ দেশভ্রমণের ফলে আত্মজ্ঞানের বৃদ্ধি হয়।
৹ দেশভ্রমণের ফলে মনের সংকীর্ণতা দূর হয় এবং মনে একাগ্রতা আসে।
৹ দেশভ্রমণের ফলে জাতিগত ভেদ ও প্রথা মন থেকে দূর হয়।
৹ দেশভ্রমণের ফলে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়।
৹ দেশভ্রমণের ফলে বহুদর্শীতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
৹ দেশভ্রমণের ফলে বিভিন্ন স্থানের ধর্ম – ভাষা – সংস্কৃতি – জীবনযাত্রার মেলবন্ধন ঘটে।
৹ এছাড়াও দেশ ভ্রমণের ফলে নিজের আচার-আচরণের পরিবর্তন ঘটে এবং নিজের মনোভাবেরও পরিবর্তন ঘটে থাকে।

বিভিন্ন পরিব্রাজকদের দেশভ্রমণ:- 
   “রতনের মূল্য জহূরীর কাছেই” –
জহুরী যেমন সঠিকভাবে রত্ন, মুক্তা চিনে নিতে পারেন, তেমনি একজন পরিব্রাজকও দেশ ভ্রমণের উপকার সঠিকভাবে বুঝতে পারেন এবং দেশ ভ্রমণে নিজেকে নিযুক্ত করেন। সেই প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন পরিব্রাজক দেশ ভ্রমণের কাজে আত্মনিয়োজন করেছেন –
খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌটিল্য দেশ ভ্রমণের নেশায় বাংলায় এসেছিলেন। তার মতে তখন বাংলায় প্রবাল, শঙ্খের মালা ও কাছিমের ছাল সংগ্রহ করা হতো।
৹ এছাড়াও চীনের প্রখ্যাত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ফা হিয়েন পায়ে হেঁটে ভ্রমণের ইচ্ছায় বাংলায় এসেছিলেন তার কথা ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তিনি শুধুমাত্র বাংলা নয়, তিনি পায়ে হেঁটে পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলংকা ভ্রমণ করেছেন। তার রচিত ভ্রমণ কাহিনীতে বাংলার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি তার ভ্রমণ কাহিনীতে বলেছেন- সেকালে বাংলায় চন্ডাল ছাড়া অন্য কেউ প্রাণীহত্যা করত না।
৹হিউয়েন সাং সুদূর চীন থেকে দেশ ভ্রমণের বাসনা নিয়ে ভারত, ভুটান, পুন্ড্র, হরিকেল, ত্রিপুরা, চন্ডিপুর প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, পরিব্রাজক এবং অনুবাদকও ছিলেন। তার জন্যই ভারত এবং চীনের মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল। তার লেখা ভ্রমণ কাহিনী থেকে বিশ্ব বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা জানা যায়। সেখানে তিনি প্রায় ৭০০ জন ভিক্ষুককে দেখেছিলেন বলে তিনি তার ভ্রমণ কাহিনীতে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও তিনি সেখানে  অধ্যাপক শীলভদ্রের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন তার পরিচয় ও তার ভ্রমণকাহিনীতে পাওয়া যায়।
ইবন বতুতাও দেশ ভ্রমণের আসক্তিকে ত্যাগ করতে পারেননি তিনিও অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি তার ভ্রমণের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করে একটি গ্রন্থ ও রচনা করেছেন গ্রন্থটি হল “ট্রাভেল অফ ইবনে বতুতা”।

■ উপসংহার :-  
      অতীতের দেশ ভ্রমণের দুর্বলতার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে দেশ ভ্রমণ শিক্ষার পরিপূরক। বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলিও তাদের পঠন-পাঠনের সঙ্গে দেশ ভ্রমণকে যুক্ত করেছে। চিন্তার পরিধির বিকাশের জন্য এবং মেধা মনন শীলতা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য একাকীত্ব ঘোচানোর জন্য দেশ ভ্রমণ এক বিশাল ঔষধ।